মৃদুভাষী সাবেক আমলা কিলিকদারোগলু কি পারবেন এরদোয়ানকে উল্টে দিতে?
রজব তৈয়ব এরদোয়ানের ছায়ার নিচে ঢাকা পড়ে ছিলেন এক দশকেরও বেশি সময় তুর্কি বিরোধী নেতা কেমাল কিলিকদারোগলু। এরদোয়ানকে দেশটির নির্বাচিত সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে মনে করা হয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃদুভাষী, চশমাধারী সাবেক আমলার চালচলনের সঙ্গে এরদোয়ানের জমকালো এবং আকর্ষণীয় জীবন শৈলীর কোনো মিল নেই। অনেকেই মনে করেন, এ কারণেই নির্বাচনে আরেক দফা পরাজয় ঘটতে চলেছে।
দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় তুরস্কতে ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে এরদোয়ান সরকার অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। বিজয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও এই মৃদুভাষী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী শেষ পর্যন্ত হেরে যাবেন বলেই বিরোধী পক্ষের অনেক সমথর্কের আশঙ্কা।
তবে তুরস্কের ছয় দলীয় শক্তিশালী বিরোধী জোটের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন বলে মার্চে ঘোষণা দেন কিলিকদারোগলু। এই ছয় জোটের বাইরের দলগুলোও পরে তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক শৈলীতে দক্ষ এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এক ঝানু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আছেন কেমাল কিলিকদারোগলু ।
৭৪ বছর বয়সী প্রাণরসে ভরপুর এ প্রার্থী তুরস্কে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তার প্রচারাভিযানের মূল সুর এটিই। এদিকে এরদোগানের প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট শাসন ব্যবস্থাকে সমালোচকরা 'এক ব্যক্তির শাসন' বলে মশকরা করেন।
কিলিকদারোগলুর কেন্দ্রীয়-বাম কুমহুরিয়াত হাল্ক পার্টি (রিপাবলিকান পিপলস পার্টি, সিএইচপি)- এর আইন প্রণেতা মুরাত আমির বলেন, "কেমাল বে'এর জয় মানে তুরস্কে আবার গণতন্ত্রের বিজয়। স্বৈরাচারী শাসন গো হারা হারবে এবং গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলো বিজয়ী হবে... গোটা দেশে জ্বলে উঠবে আশার আলো।"
হিসাব রক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ
পূর্বাঞ্চলীয় তুরস্কের টানসিলি প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী কিলিকদারোগলু পেশাজীবন শুরু করেন সরকারি হিসাব রক্ষক হিসেবে। তারপর টানা ২০ বছর ধরে পেশাদার জীবনের সিঁড়ি টপকে গেছেন। একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে তুরস্কের সামাজিক বিমা ইন্সটিটিউটের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী বুলন্দ একভিটের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক সোল পার্টি বা ডেমোক্র্যাটিক বাম দলে।
১৯৯৯'এর নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে সিএইচপি দলে যোগ দেন তিনি। তিন বছর বাদে ইস্তাম্বুলের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যোগ দেন। দুর্নীতি উন্মোচনে করিৎকর্মা হিসেবে সুনামও অর্জন করেন তিনি।
২০০৯ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র পদের জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এর এক বছর পরেই নিজ দলীয় প্রধান যৌন টেপ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় দলীয় প্রধানের পদের জন্য সমর্থকদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন সাবেক এই আমলা।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এবং সিএইপিকে হলো তুরস্কের সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দল। ১৩ বছর ধরে টানা দলটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় দলকে কামালপন্থী নীতি থেকে সরিয়ে আনেন তিনি। তার নেতৃত্বে সিএইচপি সামাজিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রূপ নেয়। এরমধ্য দিয়ে এরদোয়ানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে টেনে নিতে পারেন তিনি।
অবশ্য ২০১৯ সালে স্থানীয় নির্বাচনের আগে তার এই তৎপরতার পুরো সুফল ভোগ করা যায়নি। ডানপন্থী আই পার্টি বা গুড পার্টি এবং উগ্র-রক্ষণশীল সাদাত পার্টি (ফেলিসিটি পার্টি)- এর সাথে জোট গড়ে তার দল। তুরস্কের প্রধান কুর্দিপন্থী দল হাল্কলারম ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিপলস' ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এইচডিপি'রও সমর্থনও লাভ করেন। ফলে ইস্তাম্বুল এবং আঙ্কারাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে এ কে পার্টিকে হটিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেয় সিএইচপি।
নিজের আমলা ভাবমর্যাদাকে প্রথম উড়িয়ে দেন এর দুই বছর আগে। সে সময় ৬৮ বছর বয়সী কিলিকদারোগলু ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিকে সাড়ে চারশো কিলোমিটার শোভাযাত্রায় অংশ নেন। আঙ্কারা থেকে শুরু হয়ে এর সমাপ্তি ঘটে ইস্তাম্বুলে। সিএইচিপি'র একজন জনপ্রতিনিধির কারাগারে প্রেরণ এবং ২০১৬'এর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে সরকারী ব্যাপক অভিযানের প্রতিবাদে এই শোভাযাত্রা করা হয়।
২০১৯'এর বিজয়ের পথ ধরে বিরোধী জোটের পরিধি বাড়ান কিলিকদারোগলু। জোটকে ছয়দলীয় জোটে পরিণত করা হয়। জোটে যোগ দেয় এরদোয়ানের সাবেক দুই মন্ত্রী এবং তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এইডিপির সঙ্গে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করা হয়।
ঘরোয়া মানুষের ভাবমর্যাদা
নির্বাচনী প্রচার অভিযানে কিলিকদারোগলু নিজেকে ঘরোয়া মানুষ হিসেবে তুলে ধরার দিকে গুরুত্ব দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার এবং বিশেষ করে তুরস্কে এবারে প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন ৪৯ লাখ মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য এর ওপর জোর দেওয়া হয়। টুইটারে দেওয়া ভিডিওগুলো সাধারণভাবে তার রান্নাঘর বা পড়ার ঘরে ধারণ করা হয়। তাকে দেখা যায় আস্তিন গুটানো খোলা কলারের সাদা সার্ট পরা অবস্থায়। আর এমন বেশেই নিজ নীতিমালা তুলে ধরেন তিনি।
এমনই এক ভিডিওতে গতমাসে তার প্রার্থিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি আলাভি মতের অনুসারী। শিয়া ইসলাম, সুফিবাদ এবং আনাতোলীয় লোক সংস্কৃতির মাল-মশলায় গড়ে ওঠা জাতিগত সংখ্যালঘু ধর্মমত আলাভি। তুর্কি জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আলাভি এবং তারা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসার কারণেই কিলিকদারোগলুর ভোট জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, ভাবা হয়। কিন্তু নিজের আলাভি পরিচয় নিয়ে সরাসরি মুখোমুখি হয়ে এ সংক্রান্ত আশঙ্কাকে প্রায় বিদায় করে দিতে পেরেছেন বলেই ধারণা হচ্ছে। তিনি নিজেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তুরস্কের সব নাগরিকের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেন।
আরও গণতন্ত্রায়নের প্রতিশ্রুতি ব্যক্তের পাশাপাশি বিরোধী জোট বলছে, তারা অধিকতর প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারায় ফিরে আসবে। আবার বসন্ত ফিরে আসবে বলে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি– এমন এক ব্যানারের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক ইশতেহার তুলে ধরছে তুরস্কের বিরোধী জোট।
কিলিকদারোগলু বলেন, তুরস্কে বসবাসকারী ৩৬ লাখ সিরিয়বাসীকে দুই বছরের মধ্যে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে। বেশির ভাগ তুরস্কবাসীর কাছে এ নীতি ভালো লেগেছে। কিন্তু দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে বসবাসকারী সিরিয়রা এতে দেখতে পাচ্ছেন অশনি সংকেত।
ইস্তাম্বুলে বসবাসকারী সিরিয়বাসী কাদিম নিজের নামের প্রথমাংশেই পরিচিত হতে চাইছেন। তিনি বলেন, "ওরা যদি সত্যিই আমাদের ফেরত পাঠায়, তবে কোথায় যাবো আমরা? আসাদের হাতে প্রাণ হারানোর জন্যেই ওরা কী আমাদের ফেরত পাঠাবে? আমাদের বেঁচে থাকার কোনো জায়গা কি পাবো? পারবো কি আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে বা চাকরি-বাকরির নিশ্চয়তা দিতে?"
আল জাজিরা থেকে অনুবাদে সৈয়দ মূসা রেজা