রাখাইনে আরাকান আর্মির হাতে জান্তা বাহিনীর ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য আটক
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর দুটি সামরিক ইউনিট আটক করেছে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এক বিবৃতিতে এ দাবি করেছে। ওই অঞ্চলের একাধিক সূত্রও একই কথা জানিয়েছে। আরাকান আর্মি এই জোটের সদস্য।
বিবৃতিতে গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, সরকারি বাহিনীর সদস্যদের আটকের ফলে মিনবায়া শহরের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ এখন বলতে গেলে আরাকান আর্মির হাতে। অন্যদিকে এটি এই গোষ্ঠীকে রাজ্যটির রাজধানীর নিয়ন্ত্রণে সরকারি বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকালে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে জানায়, আরাকান আর্মি মিনবায়া শহরের লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৩৭৯ ও ৫৪১ লক্ষ্য করে আগাচ্ছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'জান্তার সব সদস্য আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।'
এই দুই ব্যাটালিয়নে ঠিক কতজন সৈন্য ছিল সেটি স্পষ্ট নয়। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক ধারণা মতে, বার্মিজ আর্মিদের বেশিরভাগ ব্যাটালিয়নেই প্রায় ২০০ সৈন্য থাকে।
তিনি বলেন, দখল মানে 'এখন মিনবায়ার নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে। সরকারি বাহিনী যেকোনো সময় বিমান হামলা চালাতে পারে এমন আতঙ্কে স্থানীয়রা ঘর থেকে বের হচ্ছে না।'
এর আগে গত অক্টোবরে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের লড়াই শুরু হয়। তখন থেকেই তারা সরকারি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানকে লক্ষ্যবস্তু করে আগাচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে রাখাইনের উত্তরাঞ্চল ও প্রতিবেশী চিন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর অবস্থানে বেশ কয়েকটি হামলা চালায় আরাকান আর্মি। এসব হামলার মধ্য দিয়ে সরকারি বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করেছিল তারা।
১৬ জানুয়ারি কিয়াকতাউ শহরের উল্লেখযোগ্য দুটি শিবির দখলের পর জান্তা বাহিনীর প্রায় ৩০০ সৈন্য আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর পর ২৪ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছিল, আরাকান আর্মি পুরো পুয়াকতাউ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
পুয়াকতাউ একটি বন্দর নগরী। এটি রাখাইনের রাজধানী সিত্তে থেকে ১৬ মাইল (২৫ কিলোমিটার) পূর্বে অবস্থিত।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এর পর জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। গত বছরের নভেম্বরে এ যুদ্ধবিরতি শেষ হয়। এর পর তারা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল (১৮ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত পশ্চিামাঞ্চলীয় চিন রাজ্যের পালেতোয়া অঞ্চলটি পুরো দখলে নেয়।
মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স দাবি করে, আরাকান আর্মি কিয়াকটোর ৯ নম্বর অপারেশনস কমান্ডের অধীন দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ছাড়া সব ব্যাটালিয়নকে আটক করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মিনবায়া শহরের ৩৭৯, ৩৮০ ও ৫৪১ ব্যাটালিয়ন, কিয়াকতাউ শহরের ৩৭৪, ৩৭৬ ও ৫৩৯ ব্যাটালিয়ন এবং ম্রাউক-ঊ শহরের ৩৭৮ ও ৫৪০ ব্যাটালিয়ন। শেষের দুটি ব্যাটালিয়ন মঙ্গলবার সকালে আটক করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরাকান আর্মি কিয়াকতাউয়ের আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন ৩৭৭ এর নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে।
যে দুটি ব্যাটালিয়ন আটক করা যায়নি সেগুলো হলো- ম্রাউক- ঊ শহরের ৩৭৭ ও কিয়াকতাউ শহরের ৩৭৫ ব্যাটালিয়ন।
রাখাইনভিত্তিক একজন সামরিক পর্যবেক্ষক আরএফএকে জানিয়েছেন, আরাকান আর্মি ৯ নম্বর মিলিটারি অপারেশনস কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দিকে মনযোগী। যাতে তারা এখান থেকে ৫ ও ১৫ নম্বরের অধীনে থাকা ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে পারে।
তিনি বলেন, 'আরাকান আর্মি যদি কিয়াকতাউয়ের অপারেশন কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তাহলে এর পর তারা রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে। এই অঞ্চলটি সামরিক আক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই আরাকান আর্মি অন্যান্য অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর ওপর কৌশলগত হামলা চালানোর জন্য এটি ব্যবহার করতে পারে।'
এই পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেন, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী ও স্থল অভিযানে সেনাদের ব্যবহারের পরও ব্যাটালিয়ন এবং শহরগুলো ছেড়ে দিচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায় আরাকান আর্মির আক্রমণ প্রতিহত করার সক্ষমতা তাদের আর নেই।
তিনি আরও বলেন, 'আরাকান আর্মি যদি ম্রাউক- ঊ ও কিয়াকতাউয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা রাজধানী সিত্তে ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, যেখানে জান্তার পশ্চিমা সামরিক সদর দপ্তর অবস্থিত।'
আরাকান আর্মি জান্তা বাহিনীর ব্যাটালিয়ন আটক, সংঘাতে হতাহত কিংবা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা সৈন্যদের সংখ্যার বিষয়ে এখনও কিছু জানায়নি।
রাখাইনের সামরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা আরেক বাসিন্দা আরএফএকে বলেন, 'দক্ষিণে অগ্রসর হওয়ার আগে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ আরাকান আর্মি রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।'
তিনি বলেন, 'আমরা এর আগে ভেবেছিলাম আরাকান আর্মি (আরাকান আর্মি) উত্তর রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ২০২৫ সালেই দক্ষিণ রাখাইনে হামলা চালিয়ে যাবে। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে রামরি ও তাংগুপ টাউনশিপে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। জান্তা সৈন্যরা বাংলাদেশ ও ভারতে পালিয়ে গেছে এবং আরও সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে।'
মঙ্গলবারের বিবৃতিতে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলেছে, তারা আশা করছেন যে আরাকান আর্মি শিগগিরই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইনের মংডু শহরের উত্তরে তুয়াং পায়ো লেত ওয়েই ও তুয়াং পায়ো লেত ইয়ার সীমান্ত ফাঁড়ি পুরোপুরি দখলে নেবে।
এ বিষয়ে জানতে গত বুধবার জান্তার মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এবং আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং থুখার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, আরএফএর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর এই তিন মাসে রাখাইনে সংঘাতে ১১০ জনেরও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫০ মানুষ।