ইসরায়েলে বিক্ষোভ কি নেতানিয়াহুর ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে?
গাজায় ছয় বন্দি মুক্তির ঘটনায় ইসরায়েলে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। গতকাল (সোমবার) দেশটির সেনাবাহিনী মরদেহগুলো উদ্ধার করে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলে হামাস আক্রমণ করে দুই শতাধিকেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে। ঐ ঘটনার ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেকেই জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মরদেহগুলো উদ্ধারের কিছু সময় আগেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পেছনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, "যারা জিম্মিদেরকে হত্যা করেছে তারা চুক্তি চায় না।"
এদিকে ইসরায়েলে গত রবিবার নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। তারা মূলত যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বর্তমান সরকারকে দায়ী করছেন।
এদিকে হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা ইজ্জাত আল-রিশেক দাবি করেন, ছয় বন্দি ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। হামাস মূলত ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে জিম্মিদের ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব জানিয়েছে। চলমান এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০,৭০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৯৪ হাজার।
গত রবিবার বিক্ষোভে নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা স্লোগান দিয়েছেন। এক পর্যায়ে তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন গতকাল (সোমবার) ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। এক্ষেত্রে শ্রম আদালত কর্তৃক শ্রমিকদের চাকরিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার আগে কয়েক ঘন্টার জন্য দেশটির অর্থনীতিতে স্থবিরতার নেমে আসে।
দেশজুড়ে এই ধর্মঘটের মাধ্যমেই নেতানিয়াহু সরকারের ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের প্রভাব আগামী দিনগুলোতে বোঝা যাবে।
ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সরকারের উপদেষ্টা এলন পিনকাস আল জাজিরাকে বলেন, "খুব শীঘ্রই এটা বলা যাবে না। এখানে মূল বিষয়টা হচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা। অর্থাৎ, বিক্ষোভ কি চালু থাকবে না-কি সেটা।"
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রসিকিউটর, নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টসহ দুই হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছেন।
গত নভেম্বর মাসে জিম্মি বিনিময় ও যুদ্ধবিরতি হলেও এরপর একটা লম্বা সময় ধরে যুদ্ধে আর অগ্রগতি হয়নি। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের বহু নাগরিকই বাকি প্রায় ১০০ জনের মতো জিম্মির মুক্তির জন্য যুদ্ধবিরতির চুক্তির জন্য নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছেন।
গত মে মাসেও হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর কঠিন সব শর্তের জন্য শেষ পর্যন্ত ঐ চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। তখন থেকে গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একইসাথে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও লেবাননে অভিযান জোরদার করেছে।
এদিকে ইসরায়েল আলোচনার পরিবর্তে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বন্দিদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, জুনের শুরুতে জিম্মিদের উদ্ধার করতে ইসরায়েল সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। যেখানে চার বন্দিকে উদ্ধার করা হলেও ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল।
নেতানিয়াহু সরকারের এমন কৌশল ইসরায়েলের ভেতরেই বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এক্ষেত্রে ছয়জন জিম্মির মরদেহ উদ্ধার যেন পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে।
ইসরায়েলের রাজনীতির ওপর বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, "সরকার ও প্রধানমন্ত্রী রক্ষণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। এখন সবকিছু মোমেন্টামের ওপর নির্ভর করছে।"
তবে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ এবারই প্রথম নয়। বরং দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কে গত বছরও ব্যাপক বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও চলতি বছরের গ্রীষ্মেও যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে।
পিনকাস বলেন, "নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতি কিংবা জিম্মিদের মুক্তির চুক্তি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। এটা পরিস্কার। কেননা দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও আমরা সবাই সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে এটি ঘটবে। একটি চুক্তিতে যুক্ত হতে তার (নেতানিয়াহুর) অনীহাই এই সমস্ত ঘটনা ঘটিয়েছে।"
জুলাইয়ে এক পোলে দেখা যায়, ৭০ ভাগ ইসরায়েলি চায় নেতানিয়াহু পদত্যাগ করুক। কেননা গত ৭ অক্টোবরের হামলা প্রতিরোধ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলে তারা মনে করেন।
তবে নেতানিয়াহুর প্রতি এখনো উগ্র ডানপন্থিদের সমর্থন রয়েছে। যাদের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল ইওয়েল স্মোট্রিচ অন্যতম।
এদিকে ছয় জিম্মির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নেতানিয়াহু বলেছেন, "এই ঘটনার জন্য যারা ইসরায়েলি দায়ী করছেন তারা মূলত হামাসের প্রোপাগান্ডার সুরে কথা বলছেন। অপহরণকারীদের হত্যার মূল্য বরং গাজাতে চুকাতে হবে। সেখানে আরও বেশি অঞ্চল দখল ও ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে।"
গোল্ডবার্গ বলেন, "নেতানিয়াহু এমন সব বিকৃত স্বৈরশাসক নয় যারা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করে। বরং তিনি বিশ্বাস করেন যে, তার ব্যক্তিগত স্বার্থই দেশের স্বার্থ। সেক্ষেত্রে তার মতে, এটি কেবল তখনই রক্ষা করা যেতে পারে যদি তিনি নেতৃত্বে থাকেন।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান