৩ হাজার ফুট উচ্চতার ব্যাটারি আগামীতে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন হতে পারে
আভিজাত্য, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে মানুষ বহু সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করেছে। তবে দেশে দেশে এখন আগের চেয়েও অনেক উঁচু উঁচু দালান-কোঠা নির্মিত হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ করা শুরু হতে পারে, আর তা হলো নবায়ণযোগ্য জ্বালানি সঞ্চয় করা।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা, যার উচ্চতা ২ হাজার ৭২২ ফুট। তবে এবার এটাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে নতুন একটি ভবন, যার উচ্চতা হতে পারে ৩ হাজার ফুটের বেশি।
বেশ কিছু সুউচ্চ ভবন নির্মাণে সুবিখ্যাত আর্কিটেকচার ও ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম স্কিডমোর, ওউইংস অ্যান্ড মেরিল (এসওএম) এবার বিদ্যুৎ কোম্পানি এনার্জি ভোল্টের সঙ্গে মিলে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
সুউচ্চ ভবন নির্মাণে এসওএমের সুনাম জগৎজোড়া। এসওএম নিউইয়র্কের ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, শিকাগোর উইলিস টাওয়ার, যা সিয়ার্স টাওয়ার নামেও পরিচিত এবং বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফার নকশা করেছে।
এসওএমের পরামর্শ সহযোগী ও বুর্জ খলিফার কাঠামো-প্রকৌশলী বিল বেকার সিএনএনকে বলেন, এই সক্ষমতা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। তাই শক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমাবে।
এটিকে ভবন না বলে বরং বিশাল একটি আকাশচুম্বী ব্যাটারি বললেই ঠিক হবে। মূলত বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনার বিষয়টি মাথায় রেখে নবায়নযোগ্য শক্তি সঞ্চয়ের এ বিশাল আকাশচুম্বী ব্যাটারি নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার সময়ে এই ভবনে থাকা বৈদ্যুতিক মোটর অনেকগুলো দৈত্যাকার ব্লক ছাদে প্রতিস্থাপন করবে। এই ব্লকগুলো 'সম্ভাব্য' শক্তি আহরণ ও সঞ্চয় করবে। চাহিদা অনুযায়ী সময়ে ব্লকগুলো নিচে নামানো হবে এবং এগুলোতে সঞ্চিত শক্তি বিদ্যুতে রূপান্তর করা হবে।
ক্লিন এনার্জি উৎপাদনের সবচেয়ে বড় বাধা হলো নবায়ণযোগ্য শক্তির উৎসগুলো সবসময় সমানভাবে কাজে লাগে না। যেমন: সৌর শক্তি না থাকলে সোলার প্যানেল কিংবা বাতাস না থাকলে টারবাইন বিদ্যুৎ উত্পাদন করতে পারে না। আবার কখনো কখনো এসব উৎস প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উত্পাদন করে, এই বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থেকে যায়।
তাই এ সমস্যা থেকে বাঁচতে উৎপাদন এবং ব্যবহারের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এক্ষেত্রে সংরক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি সঞ্চয়ের এ বিশাল আকাশচুম্বী ব্যাটারি নির্মাণ করা হচ্ছে।
নেট জিরোর জন্য গ্রিড-স্কেল স্টোরেজ প্রয়োজন
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বিশ্ব যদি ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোতে পৌঁছাতে চায়, তবে গ্রিড-স্কেল স্টোরেজ (পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত যেসব প্রযুক্তি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং প্রয়োজনের সময় রূপান্তরিত করতে পারে) বাড়ানো দরকার।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি (বৈদ্যুতিক গাড়িতে ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয়) শুধু একা এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এছাড়া এগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারে না।
দুপুরের রোদ থেকে সঞ্চয় করা শক্তি সন্ধ্যায় স্থানান্তর করার জন্য এটি কাজে লাগতে পারে। তবে এর চেয়ে বেশি সময় ধরে শক্তি সঞ্চয় করার প্রয়োজন হতে পারে।
ইতোমধ্যে নবায়ণযোগ্য শক্তি সঞ্চয় করতে বহুল ব্যবহৃত পাম্পড স্টোরেজ জলবিদ্যুৎ এ কাজটি করছে। এর একটি টারবাইন অফ-পিক আওয়ারে মাটির গভীর থেকে উঁচু জমিতে পানি পাম্প করে। চাহিদা যখন বাড়ে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী টারবাইনের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হয়। তবে এর জন্য পাহাড়ি ভূখণ্ড এবং প্রচুর জায়গা প্রয়োজন।
জানা যায়, এসওএম ও এনার্জি ভোল্টের তৈরি ভবনটির উচ্চতা ৩০০ থেকে ১ হাজার মিটার (৯৮৫ থেকে ৩৩০০ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে। ব্লকগুলো সরানোর জন্য লিফট শ্যাফ্টের মতো কাঠামো ছাড়াও, এটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্যও ভাড়া দেওয়া হবে। (নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি আকাশচুম্বী ভবনটিতে ব্লকের পরিবর্তে পানি ব্যবহার করে পাম্পড স্টোরেজ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারেও আলোচনা করছে)।
এনার্জি ভোল্টের সিইও রবার্ট পিকোনি সিএনএনকে বলেছেন, 'এই প্রকল্প দ্বারা মাল্টি-গিগাওয়াট-ঘন্টা শক্তি সঞ্চয় করা যেতে পারে, যা বেশ কয়েকটি বিল্ডিংয়ের বিদ্যুত সরবরাহের জন্য যথেষ্ট হবে।'
এ বিষয়ে সিএনএন দুজন শক্তি সঞ্চয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এই দুই বিশেষজ্ঞেরা কাছে সিএনএন কাছে জানতে চেয়েছে যে আকাশচুম্বী ব্যাটারির ধারণাটি কাজে লাগবে কি না।
তাদের মতে, শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সঠিক স্থান এবং অতিরিক্ত ওজন বহনের মতো প্রয়োজনীয় কাঠামোগত প্রযুক্তির ওপর এই প্রকল্পে সফলতা নির্ভর করবে।
তবে এনার্জি ভোল্ট এবং এসওএম তাদের এই পরিকল্পনা বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর করার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী।
এনার্জি ভোল্ট ইতোমধ্যে চীনে একটি প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। তাদের দাবি, এটি বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক-স্কেল, নন-পাম্পড হাইড্রো গ্র্যাভিটেশনাল এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম। এটি ১৫০ মিটার উঁচু (৪৯২ ফুট) বিল্ডিং, যার সংরক্ষণ ক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট ঘন্টা। শক্তি সঞ্চয় করার জন্য উদ্দেশ্যেই এটি নির্মিত এবং এই ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেই।
উচ্চতা যত বেশি, ততই কি ভালো?
নবায়ণযোগ্য শক্তি ব্যবহার অতি উচ্চ ভবনগুলোর কার্বন নিঃসরণকে ভারসাম্য করতে সহায়তা করবে। বর্তমানে ভবন এবং অন্যান্য নির্মাণ খাত বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী।
তবে এ দূষণ মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আরও ভাল নিরোধক দিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ করা থেকে শুরু করে কাঠের মতো কম কার্বন-নিবিড় বিকল্প উপকরণ দিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ প্রভুতি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
কিছু ভবন গাছে গাছে সবুজ হয়ে উঠছে। মিলানে ইতালীর স্থপতি স্টেফানো বোয়েরি গাছ এবং ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত টাওয়ার তৈরি করেছেন এবং তিনি দুবাইয়ের টাওয়ারগুলোর জন্য অনুরূপ নকশা উন্মোচন করেছেন।
তবে দ্রুত নগরায়ণের চাহিদা মেটাতে শহরগুলোতে অনেক বেশি পরিমাণে এবং উঁচু উঁচু দালান-কোঠা বানাতে হচ্ছে। এজন্য আবার প্রতিনিয়ত বহু মানুষকে শহরমুখী হতে হচ্ছে। তাই সীমিত স্থানে অনেক মানুষের জায়গা দিতে সবাই তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
কাউন্সিল অন টল বিল্ডিংস অ্যান্ড আরবান হ্যাবিট্যাটের ড্যানিয়েল সাফারিক এক ই-মেইলে সিএনএনকে বলেন, '১৯০০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ২০০ মিটারের (৬৫৬ ফুট) চেয়ে উঁচু ২৩৫টি ভবন নির্মিত হয়েছে। শুধুমাত্র গত বছরই এই উচ্চতা বা তার বেশি উচ্চতার ১৭৯টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।'
যদি মাধ্যাকর্ষণ-শক্তি সংরক্ষণ কাঠামোর কথা আসে, তাহলে যত লম্বা হয়, তত ভাল। একটি খুব উঁচু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সঞ্চয় কাঠামো, তার নির্মাণ এবং অন্যান্যভাবে নিৎসরিত কার্বন দুই থেকে চার বছরের মধ্যে ভারসাম্য করতে পারে।
এসওএম এবং এনার্জি ভল্ট এখন তাদের নকশাগুলো বাস্তবে পরিণত করার জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের সন্ধান করছে।
পিকোনি করেন, উঁচু বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রে এসওএমের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। এই বিশ্বাসযোগ্যতা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি