হেবাং: ঢাকার বুকে ভিন্ন স্বাদের পাহাড়ি খাবার
চারদিকের কোলাহল, যানজট ঠেলে রেস্তোরাঁটির ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো যেন চিরচেনা ব্যস্ত নগরী থেকে দূরে কোথাও চলে এসেছি। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি কারুকার্য ঢাকার মতো ঘিঞ্জি শহরেও এনে দিবে পাহাড়ের অনুভূতি। আর তার সাথে যদি থাকে পাহাড়ি খাবারের সমারোহ তাহলে তো কথাই নেই, মনে হবে কেউ যেন পাহাড়ের বুকে কোন রেস্তোরাঁয় বসে প্রকৃতির সাথে কথা বলছেন আর সেখানকার তাজা সবজির নানা পদের খাবার খাচ্ছেন। ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ায় আদিবাসী নারীদের পরিচালিত পাহাড়ি খাবারের এ রেস্তোরাঁর নাম 'হেবাং'। চাকমা ভাষার শব্দ 'হেবাং' অর্থ হচ্ছে ভাপে রান্না করা, এ পদ্ধতিতেই আদিবাসীরা তাদের বেশিরভাগ খাবার রান্না করে থাকেন।
রেস্তোরাঁটিতে পাহাড়ি পরিবেশ আনতে বাঁশ দিয়ে আদিবাসীদের ঘরের বাইরে থাকা বারান্দার মতো ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে বাঁশের তৈরি খুপরির মতো এই জায়গাটি। বারান্দার দু'পাশে মাটির তৈরি দুটি কলস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যাকে চাকমারা 'হুপ্তি' নামে ডাকে। খড় দিয়ে তৈরি চালার ছাউনির ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেতের ঝুড়ি এবং মেঝেতে পাতা হয়েছে মাদুর। রেস্তোরাঁটিতে রঙে আঁকা ছোটবড় দেয়ালচিত্রেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আদিবাসীদের জীবনচিত্র। সময়স্বল্পতার জন্য যারা পাহাড়ে যেতে পারছেন না বা পাহাড়ি পরিবেশে অবসর বিকেল কাটাতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য 'হেবাং' হতে পারে মোক্ষম ঠিকানা।
যেভাবে শুরু
আদিবাসী খাবারের রেস্তোরাঁর পরিকল্পনা প্রথম আসে চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় প্রিয়াংকার মাথায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে প্রিয়াংকা হলে থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি রান্নাতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী। বন্ধুবান্ধুবেরা তার হাতের কম তেল, মসলা দিয়ে রান্না করা চাকমা ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে বেশ প্রশংসা করতো এবং তাকে রেস্তোরাঁ খোলার জন্য উৎসাহ দিতো। সেসময় অনলাইনে বেচাকেনা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো এবং অনেক তরুণ উদ্যোক্তাই অনলাইনমুখী ব্যবসায় ঝুঁকছিল।
প্রিয়াংকা ভাবলেন, অনলাইনে একটি পেজ খুলে খাবারের অর্ডার নিলে কেমন হয়! মেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও কানাডা থেকে মাস্টার্স করে এসে বাড়ি বাড়ি খাবার বিক্রি করবে, সে চিন্তা থেকে পরিবারের সমর্থন মেলেনি প্রথমে।
তারপর ২০১৬ সালে তিনি ও তার বোনেরা মিলে চিন্তা করলেন, নিজেদের জন্য রান্না করা খাবার থেকে পরিমাণে কিছুটা বাড়তি রান্না করবেন এবং অর্ডার আসলে সেগুলো পাঠিয়ে দিবেন ক্রেতাদের ঠিকানায়। ঢাকায় তখন আদিবাসীদের জন্য তেমন রেস্টুরেন্ট ছিলনা। তাই পেজটি খোলার সাথে সাথে পাঁচজন দুপুরের খাবারের অর্ডার দেয়। সেসময় ক্রেতাদের কাছে ব্যাম্বু চিকেনের চাহিদা ব্যাপক ছিল।
ব্যবসা সবেমাত্র শুরু তখন, চারবোন ঠিকমতো জানতেনও না ঢাকার কোথায় কী পাওয়া যায়। বিশেষ করে, বাঁশ, কয়লা ও পাহাড়ি মুরগি পাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। তখন শীতকাল ছিল, বিপলি ও তার বোনেরা মিলে খাগড়াছড়িতে নিজেদের বাড়ি থেকে ব্যাম্বু চিকেন রান্না করে ঢাকায় এনে বিক্রি করতো। এভাবেই ধীরে ধীরে অনলাইনে 'হেবাং'-এর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়লে চারমাস বন্ধ ছিলো 'হেবাং'।
মিরপুরের কাজীপাড়ায় 'হেবাং' রেস্তোরাঁটির পূর্বে সেখানে 'মেজাং' নামের আদিবাসীদের আরেকটি রেস্তোরাঁ ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেলে চার বোন মিলে সিদ্ধান্ত নেন সেখানেই তারা তাদের অনলাইন পেজের নামে এবার 'হেবাং' রেস্তোরাঁ খুলবেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রেস্তোরাঁ হিসেবে যাত্রা শুরু করে 'হেবাং'।
বিপলি চাকমা বলেন, "আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে সকলের কাছে কাছে তুলে ধরতে চাই। অনেকের ধারণা আদিবাসীদের খাবার ভালো হয় না কারণ সেখানে তেল, মসলা কম থাকে এবং সিদ্ধ করে রান্না করা হয়। কিন্তু আমরা তাদের ধারণা ভেঙ্গে দিতে পেরেছি। আদিবাসী খাবারের রেস্তোরাঁ হলেও আমাদের এখানে আসা ক্রেতাদের বেশিরভাগই হচ্ছে বাঙালি।"
ঢাকার বুকে পাহাড়ি খাবার
ঢেকিছাঁটা চালের ভাত, ব্যাম্বু চিকেন, শুঁটকি হেবাং, পাজন, কাঁকড়া ভুনা হেবাংয়ের নিয়মিত আইটেম। শুক্রবার মেনুতে আরও কয়েকটি বিশেষ খাবারের পদ যোগ করা হয়। খাবারের নামগুলোতে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি পদগুলো খেতেও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের। চাকমাদের প্রায় সব খাবারে শুঁটকির আধিক্য থাকে। শুঁটকিকে পেস্ট বানিয়ে সেটাকে পানির সাথে মেশানো হয়। রান্নায় অন্যরা যেখানে সিদ্ধ হতে পানি ব্যবহার করে, আদিবাসীরা সেখানে ঘ্রাণের জন্য তাদের রান্নায় শুঁটকির পেস্টের পানি ব্যবহার করে। আদিবাসীদের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে শামুক গ্রেভি। মৌসুমী সবজি দিয়ে রান্না করা হয় খোলসহ শামুক। কিছু খাবার আছে যেগুলো হালকা ভাপে রান্না করতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। ঐ বিশেষ পদগুলো খেতে চাইলে ক্রেতাদের তাই আগে থেকে 'হেবাং'-এ ফোন করে জানিয়ে রাখতে হয়।
মৌসুমী সবজি যখন যেটা পাওয়া যায়, সেগুলোই রান্নাতে ব্যবহার করে 'হেবাং'। তাবা সবজি নামের খাবারটি রান্না করতে শুটকির পেস্টের সাথে চিংড়ি ও অন্য যেকোন সবজি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পাজন রান্নাতে সবচেয়ে বেশি সবজির ব্যবহার করা হয়। আর এই পদটি ছাড়া আদিবাসীদের বৈসাবী উৎসব পরিপূর্ণতা পায় না। ৪০-৪৫ রকমের সবজি দিয়েও রান্না করা হয় পাজন। কিন্তু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, পাজনে তারা সবজি নামের লম্বা একধরনের সবজি, আলু ও কাঁচা কাঁঠালের উপস্থিতি থাকতেই হবে।
ঢাকার মধ্যে কয়লায় দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাপে রান্না করা সম্ভব হয় না বলে ব্যাম্বু চিকেন রান্না করতে চুলার ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে যেভাবে রান্নাটি করা হয় তা হলো- প্রথমে বাঁশ মধ্যভাগে কেটে সেখানে মসলায় মাখানো মুরগীর টুকরো দিয়ে সাজানো হয়। তারপর চুলার ওপর বাঁশ বসিয়ে দিলে হালকা আঁচে ভেতরে থাকা মুরগী রান্না হতে থাকে।
এছাড়াও 'হেবাং'-এ নানারকম ভর্তা পাওয়া যায়। মাছ, মাংস, সবজি, শুটকির ভর্তার সাথে মেশানো হয় পাহাড়ি ঝাল মরিচ। কিন্তু দেখলে মনে হবে ভর্তায় অন্য উপাদানের চেয়ে মরিচের পরিমাণটাই বেশি। যারা অধিক ঝাল খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য রয়েছে গোটা গোটা মরিচ দিয়ে বানানো মরিচের ভর্তা। কলাপাতায় মুড়ে 'হেবাং'-এ ভর্তা পরিবেশন করা হয়। শুধু তাই নয় 'হেবাং' তাদের খাবার পরিবেশন করে মাটির বাসনকাসনে, ভাত পরিবেশন করে বেতের তৈরি ঝুড়িতে কলাপাতা বিছিয়ে। সবশেষে আছে মিষ্টি মুখ করার ব্যবস্থাও। এখানে ডেজার্ট হিসেবে আছে জুমের বিন্নি চালের পায়েস, বড়াপিঠা ও কলাপিঠা। 'হেবাং'-এ চাকমাদের খাবারের আধিক্য বেশি থাকলেও, এখানে গারো সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় মুন্ডি ও লাকসু পাওয়া যায়।
রেস্তোরাঁ পরিচালনাকারী বিপলি চাকমা বলেন, "কলাপাতা থেকে শুরু করে জুমের চাল, সবজি, শুঁটকি, পাহাড়ি মুরগি, হাঁস ও অন্যান্য সব উপাদান আমরা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি থেকে ঢাকায় প্রতি সপ্তাহে নিয়ে আসি। এজন্য আমাদের খাবারগুলোতে পাহাড়ের সজীবতার নির্যাস মিশে থাকে এবং সবকিছু ক্যামিকেলমুক্ত, ফ্রেশ থাকে। আমাদের নিজেদের কোন গাড়ির ব্যবস্থা নেই, পণ্য আনা-নেওয়া করতে যাত্রীবাহী বাস ব্যবহার করা হয় এবং সেটাতে করেই সপ্তাহে দুইদিন আমরা পণ্য আনি। ফার্মের মুরগি ও কিছু মৌসুমী সবজি ঢাকার মধ্যে পাওয়া যায়, তাই মাঝে মাঝে সেগুলো আমারা ঢাকা থেকেই কিনে থাকি। রান্নার জন্য আমাদের রাঁধুনিদের সকলেই আদিবাসী, তাই এসব রান্নার কাজে তারা বেশ পারদর্শী"।
প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এগিয়ে যাওয়া
রেস্তোরাঁ চালুর এক বছরের মাথায় করোনা মহামারি আঘাত হানলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো 'হেবাং'ও বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তখন মাসে মাসে রেস্তোরাঁর ভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল এবং সেসময় ভবন মালিকের কাছে জমা রাখা এককালীন গচ্ছিত টাকা থেকেই তিনি ভাড়া কেটে রাখেন। কিন্তু তখনো 'হেবাং'-এর অনলাইন পেজ সক্রিয় ছিল। অনেকেই ঘরবন্দী জীবনে একঘেয়ে খাবার খেয়ে তিক্ত হয়ে উঠেছিল, তখন তারা অনলাইনে 'হেবাং'-এর খাবার অর্ডার করতেন।
বিপলি বলেন, "পাঁচ বছরে আমাদেরকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমাদের বড় সমস্যার একটি সমস্যা হচ্ছে কর্মী ও রাঁধুনি পাওয়া নিয়ে। কারণ ঢাকার মধ্যে আদিবাসী রাঁধুনি পাওয়া যায় না আর আমাদের রান্নাগুলো সবাই করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অনেকেই ঢাকায় এসে থাকতে চান না। তারপর এতো দূর থেকে পণ্য আনয়ন করাটা মাঝেমাঝে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যদি কোন কারণে রাস্তায় সমস্যা হয় আর আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার ঢাকায় আসতে না পারে, তখন ওগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং ঐ সপ্তাহে আমাদের ব্যবসায় বিরাট ক্ষতি গুনতে হয়। তাছাড়া ঢাকায় এতো যানজট যে মিরপুরের বাইরে থেকে অর্ডার করা ক্রেতাদের নিকট আমরা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর খাবার পৌঁছে দিতে পারিনা"।
এতোকিছুর পরেও হিসাব করলে 'হেবাং'-এর অর্জনের ঝুলি কম না। কোন পার্টি বা অনুষ্ঠানে বড় বড় ব্যাংক ও করপোরেট অফিস থেকে 'হেবাং'-এ প্রচুর অর্ডার আসে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বয়ং এসে 'হেবাং'-এ খেয়ে উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়াতে আসা আন্তর্জাতিক ফুড ব্লগার ও ইউটিউবার 'মার্ক উইনস' এসেছিলেন 'হেবাং'-এ খেতে।
রেস্তোরাঁটির স্বত্বাধিকারী বিপলি চাকমা 'হেবাং' পরিচালনার জন্য ২০২১ সালে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বজয়া পুরস্কার, ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে 'আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক' থেকে অগ্রগামী নারী উদ্যোক্তা হওয়ায় শুভেচ্ছা স্মারক পুরস্কার এবং 'বাংলাদেশ অর্গানিক এগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক' থেকে এক্সিকিউটর পুরস্কার পান। বর্তমানে ঢাকার মোহাম্মদপুরে 'হেবাং'-এর একটি শাখা চালু করার কার্যক্রম চলছে।
বিপলি চাকমার ইচ্ছা, তার এই রেস্তোরাঁটি শুধু আদিবাসীদের খাবার না, মানুষের কাছে তাদের সংস্কৃতিকেও তুলে ধরবে। মানুষ যেমন এখন প্রচুর পরিমাণে চাইনিজ ও কোরিয়ান খাবারমুখী হচ্ছে, তেমনি একদিন সকলের কাছে আদিবাসী খাবারের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে। আর এটা শুধু স্বাদের দিক থেকে নয়, মানের দিক থেকেও কতটা স্বাস্থ্যকর ও তাজা তা সকলে উপলব্ধি করতে পারবে।