চট্টগ্রামে বস্তিবাসীদের সাথে পুলিশের সংঘাত, ৩০ জন গুলিবিদ্ধ
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সালিমপুর ছিন্নমূল বস্তি এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে বস্তিবাসীদের বাধার মুখে পড়ে অভিযানকারী দল। এর ফলে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
৮৫০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে থাকে প্রায় এক লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হওয়া জনগোষ্ঠী। তারা এখানে রয়েছে ২০০৪ সাল থেকেই।
রাবার বুলেটে আহত ৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন- মো. আলী রাজ হাসান সাগর (২৬), বাবলু মন্ডল (২৮), আমেনা বেগম (৩৫), আমেনা বেগম (৫০), মোহাম্মদ পারভেজ (২৭) এবং মোহাম্মদ রাসুল (২০)। এরমধ্যে বাবলু আনসার সদস্য এবং বাকিরা বস্তিবাসী।
চমেকে চিকিৎসাধীন আহত মো. আলী রাজ হাসান সাগর বলেন, 'কোনো ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ছাড়াই আমাদের বসতি উচ্ছেদ শুরু করে জেলা প্রশাসনের লোকজন। আমরা বসতি রক্ষা করতে গেলে প্রশাসনের লোকজন আমদের গুলি চালায়।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে জঙ্গল সালিমপুরের ছিন্নমূল ১ নম্বর সমাজ এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করলে ছিন্নমূল বস্তিবাসীরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষে পাথর ছোড়ার মাঝেই পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ে বস্তিবাসিদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে উচ্ছেদ অভিযানে যাওয়া জেলা প্রশাসনের দলটি জঙ্গল সলিমপুরের ১১ নম্বর সমাজ এলাকায় গেলে আবারও বাধার মুখে পড়ে। পরে সেখানেও বস্তিবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষর ঘটনা ঘটে। সেখানও পুলিশের রাবার বুলেট ছুঁড়ে।
বেলা ১টার দিকে জেলা প্রশাসনের দলটি আলীনগর এলাকায় পৌঁছায়। প্রথমে আলী নগরবাসীর সঙ্গে পুলিশের পাথর ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। পরে সেখানেও পুলিশ ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এসময় অন্তত ২৫ জন গুলিবিদ্ধ হয় বলে দাবি স্থানীয়দের।
অভিযান শুরুর আগে জঙ্গল সলিমপুর এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। অভিযানকারী দলের সাথে ছিল পুলিশ ও আনসারের ২০০ সদস্য। অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশরাফুল আলম।
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, আত্নরক্ষার্থে পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। 'এতে আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। তবে কতজন বস্তিবাসী আহত হয়েছে তা আমরা জানি না। '
ছিন্নমূল বস্তি যেভাবে গড়ে ওঠে
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত শহরমুখী বাস্তুচ্যূত মানুষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এলাকার বাইরে, কিন্তু নগর লাগোয়া পরিত্যাক্ত জঙ্গল ও পাহাড়ি ভূমি জঙ্গল সালিমপুরে নব্বই দশকের দিকে ক্রমান্বয়ে বসতি গড়তে শুরু করে।
বিগত সময়ে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট বস্তি, বাটালি হিল, মতিঝর্ণা, ঢেবার পাড় বস্তি, বরিশাল বস্তি, লালদিয়ার চর, নোমান বস্তিসহ অন্তত ২০টি বস্তি থেকে কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া এসব মানুষেরও ঠিকানা হয়ে উঠতে থাকে এই ছিন্নমূল।
সর্বশেষ ২০২১ সালে পুলিশ সুপারের পাহাড়, লালদিয়ারচর থেকে উচ্ছেদ হওয়া কয়েকশত উদ্বাস্তুর ঠিকানা হয়েছিল এই বসতি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূলীয় উপজেলা ছাড়াও কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, কুমিল্লার জলবায়ু উদ্বাস্তু ও নিম্ন আয়ের মানুষের ঠিকানা হয়ে ওঠে ছিন্নমূল।
চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ ২০০৪ সালে গড়ে ওঠে। সেসময় প্রতিটি ৬০ টাকার বিনিময়ে প্রায় এক হাজার প্লট (৩৫ বাই ৪৫ বর্গফুট) হস্তান্তর করে সংগঠনটি। গত প্রায় দুই যুগে এই সংগঠনটি সরকারি খাসভূমিকে ১১টি ভাগে ভাগ করে গড়ে তোলে হাজার প্লট। সরকারি কোনো সহায়তা না নিয়েই এই সময়ে তারা রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, মসজিদ আর মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে।
এই এলাকার দুই কিলোমিটার পাকা রাস্তা নিজস্ব অর্থায়নে বানিয়েছে বাসিন্দারা। বৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায়, বস্তির বাসিন্দারা বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া বিদ্যুৎ সংযোগ কিনে ব্যবহার করেন। স্থানীয় এমপিরাসহ কিছু দাতব্য সংস্থাও এখানে মসজিদ, স্কুল ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে।
ছিন্নমূলে আছে ৩টি প্রাথমিক ও ১টি উচ্চ বিদ্যালয়; ৪টি মাদ্রাসা, ১২টি মসজিদ, ৩টি কেজি স্কুল, ৩টি এতিমখানা, ৬টি গোরস্তান, ৫টি মন্দির, ২টি কিয়াং, ১টি চার্চ, একটি শ্মশান ও একটি কাচাবাজার। রয়েছে অন্ধ ও ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জন্য বিশেষ জোন। তবে এই বস্তিতে জন্ম নেওয়া ১২ হাজার শিশুকে জন্ম নিবন্ধন না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ছিন্নমূলকে কেন্দ্র করে এর আশেপাশের জায়গাসহ প্রায় ৩,১০০ একর খাস জমিতে গড়ে উঠে স্থাপনা, প্রভাবশালীরা প্লট করে স্ট্যাম্পে নিম্ম আয়ের মানুষের কাছে বিক্রি করে। ছিন্নমূলের পাশে সরকারি জায়গা দখল করে আলী নগর এলাকায়ও ১,৫০০ একর জমিতে গড়ে উঠে বসতি।
তবে গত ২৩ জুন জেলা উন্নয়ণ কমিটির সমন্বয় সভায় জঙ্গল সলিমপুরের ৯০০ একর খাস জমিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, নভোথিয়েটার, স্পোর্টস ভিলেজ হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র ও নাইট সাফারি পার্কসহ একাধিক সরকারি স্থাপনা তৈরীর পরিকল্পনার কথা জানান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান।
২২ জুলাই থেকে ২৩ আগষ্ট পর্যনন্ত নয়টি অভিযানে জঙ্গল সলিমপুরের আলী নগরের ১৭০ টি উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। ২৪ আগষ্ট জঙ্গল সলিমপুরে অবৈধ বসতিতে উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় ১৭০টি স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। একটি বাদে সকল বিকল্প রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন সময়ে চলে আসা উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সঙ্গে বস্তিবাসীর সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের দায়ের করা ছয়টি মামলায় অন্তত এক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে আসামি করা হয়েছে।
২০ আগষ্ট সেখানকার বসবাসকারীরা ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিজ দায়িত্বে স্থাপনা ও মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে উচ্ছেদ বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে বাধে সংঘর্ষ।