মশা নিধনে ১,২৮৮ কোটি টাকার প্রকল্প
চলতি বছর দেশে আবারো দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এই বাস্তবতায়– মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের একটি পূর্বাভাস মডেল তৈরিতে ১,২৮৮ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং নিকটবর্তী দুটি পৌরসভা– সাভার ও তারাবো'য় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি)-ও প্রকল্পের আওতায় থাকবে।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ১,০৭৩.৭০ কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক। অনুমোদনের জন্য গত সপ্তাহে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
এবছর দেশে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর। শনিবার (২২ জুলাই) সকাল পর্যন্ত মশা-বাহিত এ রোগে আক্রান্ত ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মোট ৩০ হাজার ৬৮৫ জনের আক্রান্ত হওয়া এবং ২৩,৮৬২ জনের সেরে ওঠার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দেশে ২০২২ সালে রেকর্ডসংখ্যক ২৮১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জন ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা শনাক্তে ঢাকা মশা নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে একটি সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা ইউনিট (ইন্ট্রিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানজমেন্ট ইউনিট বা আইভিএমইউ) এবং একটি কেন্দ্রীয় জৈবিক (পতঙ্গবিজ্ঞান) ল্যাবরেটরি স্থাপন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি)।
রোগ-বিস্তারকারী কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া হবে- আইভিএমইউ। ফলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ হ্রাস বা বিস্তার রোধের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যাবে। এই ধরনের ইউনিটে সাধারণত পতঙ্গবিদ, রোগতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সামাজিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা থাকেন।
প্রকল্প প্রস্তাবের নথি অনুসারে, আবহাওয়া বিভাগের সাথে যোগাযোগ রেখে এলজিডি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দেওয়ার একটি মডেল তৈরি ও তা কার্যকর করবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জলবায়ুর সাথে ডেঙ্গু-বিস্তারের সম্পর্ক আছে। ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট উদ্যোগের সাথে আবহাওয়া অফিসের সম্পৃক্ততা থাকলে মশাবাহিত রোগ বাড়বে কিনা– তার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে ।
এছাড়া, আইভিএমইউ এর অধীনে বছরব্যাপী মশক-জরিপ পরিচালনা করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এলজিডি'র কর্মকর্তারা জানান, নিয়মিত জরিপের মাধ্যমে কোনো এলাকায় মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির ঝুঁকি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে, যার ভিত্তিতে ভিত্তিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সক্রিয়ভাবে সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে পারবে।
প্রকল্পের আওতায় গড়ে তোলা জৈবিক পরীক্ষাগারে ডেঙ্গু শনাক্তে একটি রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ-পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশন (আরসি-পিসিআর) যন্ত্র স্থাপন করবে এলজিডি। একইসঙ্গে, ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এডিস ইজিপ্টি'র মতোন বিভিন্ন রোগবাহক মশাকে জীবন্ত রাখতে একটি পতাঙ্গাগার বা ইনসেক্টেরিয়াম নির্মাণ করবে।
এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির স্ত্রী এডিস মশা মানুষের দেহে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া ছড়ায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধহ্যাপক ড. খায়রুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা একটি ভালো উদ্যোগ। ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগ বিস্তারকারী মশক নিয়ন্ত্রণে এ ধরণের উদ্যোগ নেয়ার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। তবে মশক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এ প্রকল্পে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিলে সাফল্য অনেকগুণ বেড়ে যাবে।"
২০২৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে 'ইমপ্রুভমেট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেনটিভস সার্ভিসেস প্রজেক্ট' শীর্ষক প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করবে এলজিডি।
অনুমোদনের পর চলতি শুধুমাত্র অর্থবছরেই প্রকল্পটির ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা হবে ২৫১.৫৫ কোটি টাকা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক (পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগ) ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, প্রকল্পটি মূলত দুটিভাগে বাস্তবায়ন হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এর একটি অংশ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে এলজিডি। সিটি কর্পোরেশনগুলোও বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে থাকবে। প্রকল্পের এ অংশের মাধ্যমে মূলত মশক নিধনের যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আরেকটি অংশ বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ অংশের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
এলজিডি কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। দাতা সংস্থাটির একটি টেকনিক্যাল মিশন এইড-মেমোয়ার তৈরির কাজ করছে। এলজিডি সচিবের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ২৩ মে এবিষয়ে একটি বৈঠকও হয়েছে।
কেবল ডেঙ্গুকেই প্রকল্পের বিবেচনায় রাখা হয়নি, এর আরেকটি লক্ষ্য চিকুনগুনিয়ার ওপর গবেষণা। পাশাপাশি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ-প্রতিরোধের বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন, বলেও জানান তারা।
প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য উদ্যোগ
প্রকল্পের আওতায় আরও কিছু প্রধান প্রধান উদ্যোগ থাকছে, এরমধ্যে একটি হলো – ঢাকা মশা নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে একটি প্রশিক্ষণ পরীক্ষাগার স্থাপন এবং মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির বাস্তবায়ন।
এবিষয়ে জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করা হবে। পাশাপাশি সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা ইউনিটের অধীনে কার্যকরভাবে মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে- লার্ভিসাইড, অ্যাডাল্টিসাইডের মতোন কীটনাশক এবং স্প্রে ও ফগিংয়ের মাধ্যমে তা ছড়ানোর যন্ত্রপাতিও কেনা হবে।
এছাড়া, বাসাবাড়ির মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) তৈরির লক্ষ্যও রয়েছে প্রকল্পটির। এ ধরনের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) বা চুক্তি-ভিত্তিতে যা বাস্তবায়িত হবে।
এছাড়া, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে- উন্মুক্ত ময়দান, খেলার মাঠ, পার্ক, ফুটপাথকে হাঁটাচলা, ব্যায়াম ও বিনোদনের স্থান হিসেবে রূপান্তরিত করতে সহায়তা দেবে এই প্রকল্প।
খাদ্যের নিরাপত্তা ও মান নিশ্চিতে ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিসহ গড়ে তোলা হবে জনস্বাস্থ্য পরীক্ষাগার।
এছাড়া, বায়ু ও শব্দ দূষণ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিরসনের উদ্দেশ্যেও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি থাকবে। একইসঙ্গে, মানব শরীরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কেও সামাজিক প্রচারণা চালানো হবে।
ডেঙ্গু এখন সারাবছরের হুমকি
অতীতে জুন-জুলাই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তো, কিন্তু এখন বছরজুড়েই মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে এই রোগের প্রকোপ।
বর্তমানে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী ও তাদের মৃত্যুর ঘটনা দেশের প্রায় সকল বিভাগে ঘটছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইসিডিআর) উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণ, ঘনবসতি, গ্রাম ও শহরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো বিরতি ছিল না। এখন সারাবছর ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হচ্ছে।
ডেঙ্গু ছাড়াও চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরণের রোগ বাড়ছে। ভেক্টর-বর্ন এসব রোগ থেকে বাঁচতে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট জরুরি। পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা মোকাবেলায় জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।