দেশি মিরকাদিম গরু, হাঁস ও ভেড়ার জিন রহস্য উন্মোচন দেশের গবেষকদের
দেশে প্রথমবারের মত নিজস্ব সক্ষমতায় দেশীয় প্রজাতির মিরকাদিম গরু, দেশি জাতের ভেড়া ও হাঁসসহ মোট ৩টি প্রাণীর পূর্নাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করেছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি)।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই সাফল্য প্রাণীগুলোর সংরক্ষণ, মাংস উৎপাদন ও বিশেষত্ব নির্ধারণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আজ বৃহস্পতিবার (১০ই আগস্ট) সকালে আশুলিয়ার শ্রীপুরে অবস্থিত এনআইবি'র হলরুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অর্জন তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান।
অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির মহাপরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সলিমুল্লাহ, এনআইবির আওতাধীন 'সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড এনালাইটিকস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কেশব চন্দ্র দাস, বায়ো-ইনফরমেটিক্স বিভাগের বিভাগীয় ইনচার্জ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেনসহ এনআইবি ও গবেষণাদলের অন্যান্য কর্মকর্তারা।
এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, 'দেশের যত পশু-পাখি, গাছপালা রয়েছে- সেগুলোর কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং অরিজিনাল বিষয়গুলোকে রক্ষা করতে আমরা একটি জিন ব্যাংক তৈরি করেছি। এসবকিছু বায়ো-টেকনোলজির মধ্যে পড়ে। দেশে জীববৈচিত্র্যের যে স্বতন্ত্র বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোকে ভালোভাবে জানতে চাই আমরা।'
সংবাদ সম্মেলনে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির মহাপরিচালক ড. মো. সলিমুল্লাহ বলেন, 'পার্থক্যটা হচ্ছে এর আগে আমরা যেসব জিনোম সিকোয়েন্স করেছি, সেখান থেকে প্রাপ্ত ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করে যে ফলাফল; সেটি কিন্তু এর আগে বাংলাদেশে আর হয়নি। আমরা এখন যেকোনো জিনোম সিকোয়েন্স এবং তা এনালাইসিস করতে পারছি, এটাই হচ্ছে পার্থক্য' - তিনি যোগ করেন ।
তিনি বলেন, এটা আমাদের এ গবেষণার প্রাথমিক একটি ধাপ। যেমন মীরকাদিম প্রজাতির গরুর জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি এর বৈশিষ্ট্যগুলো কি। প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে- পরবর্তীতে আমরা সিলেকটিভ ব্রিড তৈরি করতেপারব। অধিক মাংস বা দুধ উৎপাদনে ভূমিকা রাখা জিনগত বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করে তা অন্য জাতে স্থানান্তর করতে পারব। এই গবেষণা আমাদের দেশের নিজস্ব জাতের যেসব গবাদিপশু, প্রাণী আছে- সেগুলোকে রক্ষা ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।'
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। জীবের অঙ্গসংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এর জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা থেকে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সব নিউক্লিওটাইডসমূহ (জৈবঅণু) কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা নিরূপণ করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়।
সংবাদ সম্মেলনে এনআইবির কর্মকর্তারা জানান, জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির অগ্রগতি ইতোমধ্যে কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে বিভিন্ন ফসল, পশুসম্পদ এবং জীবাণুর জিনোম সিকোয়েন্স করার মাধ্যমে গবেষকরা বিভিন্ন জীবের জেনেটিক গঠন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারছেন।
একইসাথে এসব তথ্যা বিভিন্ন জীবের উৎপাদনশীলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পুষ্টির মান উন্নত করতে সাহায্য করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং সেইসাথে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিসমূহ শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাব কমিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ হতে এর আগে পাট, মহিষ, ইলিশ, করোনা ভাইরাসসহ বিভিন্ন জীবাণুর জিনোম সিকোয়েন্স ঘোষণা করা হলেও– তার সিংহভাগই বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে সম্পন্ন হয়েছে এবং পরবর্তীতে এই সমস্ত সিকোয়েন্সের অধিকাংশের এসেম্বলী ও এনোটেশনের কাজও বিদেশী সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে।
এনআইবি জানায়, ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি দেশি গরু, ভেড়া ও হাঁসের জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা শুরু হয়।
মূলত প্রকল্পটির আওতায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াসহ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীবসম্পদের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গবেষণাগার, তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্য সংরক্ষণাগার সুবিধাদি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ধরনের জিন বিশ্লেষণ প্রযুক্তি দেশের প্রাণিসম্পদ শিল্পে গবাদিপশুর আরও সুনির্দিষ্ট উপায়ে প্রজনন, মাংস ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পুষ্টিমানের উন্নয়নসহ দেশি গরুর জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সহায়তা করবে বলে মনে করেন এনআইবির কর্মকর্তারা।
এনআইবি'র বিজ্ঞানীরা আরও জানান, জিনোম এসেম্বলি ও বিশ্লেষণ শেষে দেশীয় এই মিরকাদিম জাতের গরুটির জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২২৩, ৪৫, ৩২, ৮৫৬ জোড়া নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, মিরকাদিম গরুর জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২২৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৬ জোড়া নিওক্লিউটাইড পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এ জাতটির ভারতের জেবু জাতের গরুর সঙ্গে মিল রয়েছে। এছাড়া এটির নিজস্ব জেনেটিক বৈশিষ্ট্যও উঠে আসে এ গবেষণায়।
ভেড়া ও হাঁসের জিনোম বিশ্লেষণ করে যথাক্রমে ২৮৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৫ জোড়া এবং ১৩৩ কোটি,৬৫ লাখ ৪ হাজার ৭৩৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড পাওয়া যায়।