কতোটা এগিয়েছে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং?
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা ৩৭ বছরের। সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে চিত্র, এগিয়েছে দেশের ক্রিকেট। ওয়ানডেতে তৈরি হয়েছে বলার মতো অবস্থান। ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাট টেস্টে মেলে জয়ের স্বাদ, টি-টোয়েন্টিতেও ওড়ে বিজয় নিশান। ক্রিকেটের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে অন্যতম আম্পায়ার এবং আম্পায়ারিং। ক্রিকেটের পাশাপাশি বাংলাদেশের আম্পায়ারিং কতোটা এগিয়েছে?
সদ্যই ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বললেই মিলবে উত্তর। জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) পশ্নবিদ্ধ আম্পায়ারিংয়ের কারণে গঠন করতে হয়েছে কমিটি। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে আরেকটি টুর্নামেন্টে নেওয়া হয়নি সাতজন আম্পায়ারকে। এটা নিতান্তই সদ্য বলে উল্লেখ করা। আদতে বাংলাদেশের ঘরোয়া আম্পায়ারিংয়ের চিত্র এমনই।
ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে আলোচনার শেষ নেই, যা অনেক পুরনো। অবশ্য বহু বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও বলতে গেলে কোনো পরিবর্তনই আসেনি। বিশেষ করে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের আম্পায়ারিং নিয়ে প্রতি মৌসুমেই থাকে ভুরিভুরি অভিযোগ। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে সাকিব আল হাসান স্টাম্পে লাথি মারার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছেন। মাঠেই আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়ানো, মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে চাওয়ার মতো ঘটনা আছে অনেক।
এসব চিত্রই বলে দেয় কতোটা এগিয়েছে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেবল আম্পায়ারের সংখ্যা বেড়েছে, বাড়েনি মান। বাজে আম্পায়ারিং, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক তৈরি হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এ যেন ঘুণে ধরা এক ব্যবস্থা, অন্ধকারে থেকে যাওয়াই যার অমোঘ নিয়তি। বিষয়টি নিয়ে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্তা সংস্থা বিসিবির তেমন মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবে রূপ নেয় না।
এতো অভিযোগ, সমালোচনার মাঝেও অবশ্য কয়েকটি নাম উল্লেখ করার মতো। নাদির শাহ, এনামুল হক মনি, শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত, আনিসুর রহমান, মাসুদুর রহমান মুকুলরা দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় আম্পারিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে শরিফুদ্দৌলার ক্যারিয়ার সবচেয়ে ঝলমলে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন।
পাঁচটি ম্যাচে অনফিল্ড আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব পালন করা ৪৭ বছর বয়সী এই আম্পায়ার কেবল হতাশার কথাই বললেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের আম্পায়ারিং কতোদূর এগিয়েছে বললে বলতে হয়, আমাদের কিছুই এগোয়নি। এগোলেও পিছিয়ে যাই। সামগ্রিকভাবে বললে খুব একটা এগোয়নি আমরা। প্রক্রিয়া উন্নত না করলে এগোবেও না। গবরে পদ্মফুল হবে না, হলেও কেউ তুলে আনবে না।'
'কাঠামো উন্নত না করলে সম্ভব নয়, এটা একটা কারণ। এরপরও এগোয়নি বললে ভুল হবে। আমি বিশ্বকাপে গেলাম, টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করলাম। সেই হিসেবে এগিয়েছে, কিন্তু আরও অনেক বেশি এগোনো উচিত ছিল। এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপের বাছাইয়ে আমাদের আম্পায়াররা দায়িত্ব পালন করছে। এসব বিবেচনায় এগিয়েছে। কিন্তু আগের কথাই বলতে হয়, প্রত্যাশিতভাবে হয়নি সেটা।' বলেন তিনি।
বারবার গঠন ব্যবস্থায় জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, 'কাঠামো যদি উন্নত না করেন, মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়ন যদি ঠিক না হয়, তাহলে এগোবে না। ক্রিকেট আপডেট হয়, আম্পায়ারিংও আপডেট হচ্ছে। আমরা পুরনো জায়গায় পড়ে আছি, কেবল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ওপর ভর করে আছি। কেবল আউট দেওয়া নয়; মাঠে ক্রিকেটারদের সামলানো, কোনো ঝামেলা হলে সামাল দেওয়া, যোগাযোগ করা; এসব দেখতে হয়। এগোচ্ছে, তবে আরও গতি দরকার।'
বাংলাদেশ দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করাসহ ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক দলকে শিরোপা এনে দেওয়া মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনেরও একই মত। স্থানীয় এই কোচ বলেন, 'আমার দৃষ্টিতে আসলে তেমন কিছুই এগোয়নি। কিছু আম্পায়ারের স্ট্যান্ডার্ড অনেক ভালো। যারা তাদের পেশার ব্যাপারে অনেক সচেতন ছিলেন, তারা এগিয়েছেন। সততা নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তারা অনেক ভালো পর্যায়ে চলে গেছেন। সবার ক্ষেত্রে এমন ঘটেনি। সামগ্রিকভাবে সবার মান বাড়েনি, অর্থাৎ ওইভাবে আম্পায়ারিংয়ের মান এগোয়নি।'
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রধান কোচ ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্লাবে কোচিং করানো সারওয়ার ইমরান মনে করেন, ক্লাবের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং এগোয়নি। তিনি বলেন, 'দুই-চারজন ভালো আম্পায়ার আছেন। আমার মনেহয় ওপরের ক্লাবের প্রভাব যদি না থাকে, তাহলে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং অনেক ভালো হবে। ক্লাবের চাপেই আম্পায়ারিং খারাপ হয় মূলত। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের নজির দেখা যায়। কাউন্সিলরশিপের একটা প্রভাব আছে। কারণ এখানে রেলিগেশন, সুপার লিগের মতো ব্যাপার থাকে; এসবের কারণে আম্পায়ারিং প্রভাবিত হয়, খারাপ হয়। এটা থাকা পর্যন্ত বলার সুযোগ নেই যে বাংলাদেশের আম্পায়ারিং এগিয়েছে। সত্যি বলতে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মতো আমাদের আম্পায়ারিংয়ের মান অনেক খারাপ।'
আম্পারিংয়ে সাবেক ক্রিকেটারদের না আসার কারণ
সাবেক ক্রিকেটারদের আম্পায়ারিংয়ে না আসতে চাওয়ার মূল কারণ পারিশ্রমিকের পরিমাণ। পাশাপাশি সম্মানও জড়িত বলে মনে করেন শরফুদ্দৌলা। বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডে খেলা সাবেক এই ক্রিকেটার বলেন, 'ক্রিকেটাররা আসে না, আবার আসেও। মনি ভাই ছিলেন, আনিস ভাই ছিলেন, আমি ছিলাম; যারা জাতীয় দলে খেলেছি। নাদির ভাই অনেক দিন ক্রিকেট খেলেছেন। নাদির ভাই বাদ পড়লেন, মনি ভাই অবসর নিলেন, আনিস ভাই বিদেশে চলে গেল। তো সব মিলিয়ে সংখ্যাটা বেশি নয়, এটা বাড়তির দিকে যাওয়ার কথা ছিল।'
'পথটা কঠিন, আপনি সফল হবেন, নিশ্চয়তা নেই। পরিচিত পথে হাঁটা নয়। কোচিংয়ে গেলে আপনাকে স্যার বলবে। আম্পায়ারদেরও বলা উচিত, আমাদের সংস্কৃতিতে সেটা নেই। আম্পায়ারদের সম্মানটুকু নেই, তাই তারা আসতে চায় না। এ ছাড়া আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি। এখানে খুব বেশি টাকা নেই। অথবা আমাদের এখানে কখনও পাইওনিয়ার ছিল না, জানতাম না কখনও এলিট আম্পায়ার হতে পারব কিনা, বিশ্বকাপে কেউ গেছে কিনা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাটা খুব জরুরি। কারণ আম্পায়রিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনি অন্য কোথাও চাকরি পাবেন না। এই চ্যালেঞ্জের কারণেও অনেকে আসতে চায় না।' যোগ করেন তিনি।
শরফুদদ্দৌলা আরও বলেন, 'পরিচিত পথ নয়, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সম্মান; মূলত এই তিন কারণে আসতে চায় না সেভাবে। ক্রিকেটারদের খারাপ আচরণ প্রভাব ফেলে। মোটা চামড়া নিয়ে খুব কম মানুষই আসতে পেরেছে, এটা থাকতে হবে আম্পায়ারিং করতে। বাংলাদেশে অনেক ব্যাপার থাকে। এখানে কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে আম্পায়ারিং করতে দুটি জিনিস লাগে, শরীরে তেজ ও মোটা চামড়া। এই দুটি যদি আপনার অতি মাত্রায় না থাকে, টেকা যাবে না। আমার না থাকলে ১০ বছর আগে উধাও হয়ে যেতাম। সাকিব-তামিম আসবে না, কারণ ওরা যে টাকায় কামিয়েছে, এখানে তার ধারেকাছেও নেই। বরং কোচিংয়ে যাবে, সেখানে অল্পতেই বেশি কামানো সম্ভব।'
সালাহউদ্দিনের ব্যাখ্যাও অনেকটা এমন, 'আমাদের সাবেক ক্রিকেটাররা সেভাবে আম্পায়ারিংয়ে আসে না। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই এটার মূল কারণ। আম্পায়ারিংয়ে তেমন অর্থ নেই সত্যি বলতে। পারিশ্রমিক আরও একটু ভালো হলে আমার মনে হয় ভালো মানের ক্রিকেটাররাও এই পেশায় আসবে। পাশাপাশি সম্মানের একটা ব্যাপারও আছে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়, এসব তো সবাই দেখে। তবে অর্থনৈতিক কারণটাই মূল। খেলোয়াড়ি জীবনে তারা যেভাবে অর্থ আয় করে, এখান থেকে সেভাবে আয় করার সুযোগ নেই।'
আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান ইফতেখার আহমেদ মিঠু এ দুজনের সঙ্গে সুর মেলালেন। তার ভাষায়, 'পারিশ্রমিক এখানে বড় একটা কারণ, মূল কারণই এটা। সেভাবে অর্থ না থাকায় সাবেক ক্রিকেটাররা আসতে চান না। ধরুন একজন ক্রিকেটার এখন ক্রিকেট খেলে পাচ্ছেন ৫ লাখ টাকা। অবসর নেওয়ার পরে ২৫০০ টাকার জন্য কেউ কষ্ট করবে? শুরুতে এমনই পারিশ্রমিক, স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আম্পায়াররা এটা পেয়ে থাকেন। তো ভালো মানের ক্রিকেটারদের এখানে আনতে পারিশ্রমিক বাড়াতে হবে। আমি ১৫ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছি, দেখা যাক। এ ছাড়া মাঠে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সম্মান না পাওয়ার শঙ্কাও থাকে। এর জন্য অবশ্য তাকে ভালো আম্পারিংও করতে হবে।'
আম্পায়ার হওয়ার প্রক্রিয়া ও পারিশ্রমিক
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যে কেউ আম্পায়ার হতে পারেন। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্তত এইএসসি পাস হতে হবে এবং বয়স হতে হবে ৩৫-এর নিচে। যদিও ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি শিথিল রেখেছে বিসিবি। আম্পায়ার হতে প্রক্রিয়া মেনে কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। আম্পায়ার চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বিসিবি থেকে। বাছাইকৃত আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর কৃতকার্যদের মধ্য থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিযোগী চূড়ান্ত করা হয়।
ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত করে তাদেরকে মাঠের আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, বিসিবির তালিকাভুক্ত আম্পায়ারদের বিশেষ করে নিজ জেলায় দায়িত্বে রাখা হয়। এখানকার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়ে তুলে আনা হয় স্কুল ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। আম্পায়ার্স প্যানেলে যাদেরকে নেওয়া হয়, তাদেরকে আরও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্কুল ক্রিকেটের পরে আম্পায়ারিংয়ের বিভিন্ন ধাপের কোর্স করতে হয় তাদের। লেভেল-১ কোর্সের পর তৃতীয় শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়। লেভেল-২ কোর্সের পর দায়িত্ব দেওয়া প্রথম শ্রেণি বা লিস্ট 'এ' ম্যাচে। এসব ধাপ পেরিয়ে আইসিসির আম্পায়ার হতে লেভেল-৩ কোর্স করাসহ বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির বিভিন্ন রিফ্রেশার কোর্স করতে হয়, রিপোর্ট লেখার সামর্থ্য থাকতে হয়।
প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল), বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) চারদিনের ম্যাচে অনফিল্ড আম্পায়ারিং করে ৪০ হাজার টাকা পান আম্পায়াররা। রিজার্ভ আম্পায়ারা পান ২৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) আম্পায়াররা ২৩ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পান। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারদের পারিশ্রমিক ১০ হাজারের মতো। 'এ' দলের ম্যাচে আম্পায়ারদের পারিশ্রমিকও ১০ হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শেণিতে ৬ হাজারের বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন আম্পায়াররা। তৃতীয় শ্রেণির ম্যাচে আম্পায়ারা ৩ হাজার টাকা পান। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও স্কুল ক্রিকেটে একদিনের ম্যাচে আম্পায়ারদের পারিশ্রমিক ২৫০০ টাকা। সব পর্যায়ের আম্পায়ারদের পারিশ্রমিক থেকে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয় কর বাবদ।