কলম্বিয়ার জঙ্গল থেকে ইউক্রেন: এক যোদ্ধার মৃত্যুকে বারবার ফাঁকি দেওয়ার গল্প
৩২ বছর বয়সি ফাবিয়ান কয়ের জন্ম কলম্বিয়ায়। গত ২২ মাস ধরে তিনি ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করছেন।
'সমাজ পরিবর্তনের' লক্ষ্য নিয়ে ২০২১ সালে স্বদেশ ছেড়ে স্পেনে এসে ওঠেন তিনি। পেশাদার সৈনিক কয়ের অভিজ্ঞতা আছে পরিবহন কোম্পানির নিরাপত্তা কন্ট্রাকটর হিসেবেও। কলম্বিয়ার ওপর বিরক্ত হয়েই দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
কিয়েভের একটি রেস্তোরাঁয় বসে কয় বলেন, 'স্পেনে এসে প্রথমবারের মতো মনটা শান্ত হলো।' কয় জন্মেছিলেন কলম্বিয়ার মেতা প্রদেশে। সেখানকার রাস্তাঘাট অনিরাপদ, প্রায়ই ঘটে সহিংসতা। 'জীবনের মূল্য সব হিসেবনিকেশ বদলে দেয়। একবার হারালে আবার ফেরত পাওয়াটা খুব কঠিন,' বলেন কয়।
কিন্তু এখন নতুন একটা প্যারাডক্স কয়ের সামনে। পূর্ব ইউরোপের রণাঙ্গনে নেমে তিনি এখন জীবনের মূল্য নতুন করে বুঝতে শুরু করেছেন। 'কিন্তু ইউক্রেনে আমি স্রেফ আমার দায়িত্বটুকু পালন করতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, আমার একার পক্ষে দেশটাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।'
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনের আক্রমণ চালানোর দিন তিনেক পরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার দেশকে সাহায্য করার জন্য বিদেশিদের কাছে আহ্বান জানান। সে ডাকেই সাড়া দিয়ে আরও অনেক বিদেশির মতো ইউক্রেনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন কয়ও।
বিদেশি সেনাদের ইউনিটে এখন পর্যন্ত মোট কতজন অংশ নিয়েছেন, সে সংখ্যাটি নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপন রেখেছে ইউক্রেন। তবে জানা গেছে, প্রায় ৫৫টি দেশের মানুষ এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও পোল্যান্ডের নাগরিক। এছাড়া পর্তুগাল, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, জাপান, স্পেন ও কলম্বিয়া থেকেও অনেকে ইউক্রেনে গিয়েছেন।
কতদিন ধরে ও কী ধরনের পদে কাজ করছেন, তার ওপর নির্ভর করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন ফর দ্য ডিফেন্স অভ ইউক্রেনের সৈন্যরা বেতান পান। তবে বেতনের পরিমাণটা মাসে দুই হাজার ৭০০ ডলারের আশপাশে থাকে বলে জানা গেছে।
কেবল যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরই এ সৈন্যদের দেশের কথা জানা যায়। আবার অনেক সময় মৃত্যু হলেও যে পরিচয় জানা যাবে, সে ভরসা করা যায় না। রাশিয়ান সৈন্যরা ইউক্রেনে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ফরাসি নাগরিককে হত্যা করেছে এমন দাবির পর গত বৃহস্পতিবার মস্কো ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। যদিও প্যারিস বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ কয় নিজেও একবার 'মারা গিয়েছিলেন' (রাশিয়ান মিলিটারি ব্লগের বরাতে জানা গিয়েছিল)। বলা বাহুল্য, সেটা মিথ্যা খবর ছিল।
ক্রেমলিন নিহত এই ফরাসি নাগরিকদেরকে মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে কয়ের কাছে অর্থের জন্য কোনো বিচারবিবেচনা না করে লড়াই করা ও কোনো ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করার মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট। কয় নিজেকে দ্বিতীয় পক্ষে রেখেছেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের পেছনে তিনি 'স্বাধীনতা'কে কারণ হিসেবে দাবি করেন।
রাশিয়ার আক্রমণের সময় কয় মাদ্রিদে ছিলেন। ছুটো কাজ করতেন, সেইসঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্প্যানিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। ইউক্রেনে আক্রমণের পরপরই কয়ের দাদি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুমি এ যুদ্ধে যাচ্ছোই, তা-ই না?' সত্যটা হলে, ছোটবেলা থেকেই কয় যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সবকিছু খুব দ্রুত ঘটেছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারি মাদ্রিদে ইউক্রেন দূতাবাসের কাছে পাঠানো বার্তাটি কয় নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। 'কাল আসুন,' উত্তরে লিখেছিল দূতাবাস। এর কয়েকদিন পরেই পূর্ব ইউরোপের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এক কনভয়ে চড়ে বসেন কয়। 'আমি ইউরোপে এসেছি বাস করতে। এটাকে আমার রক্ষা করতে হবে, কারণ ইউক্রেনের পর আরেকটা যুদ্ধও শুরু হতে পারে,' মনে মনে ভেবেছিলেন কয়।
৩২ বছরের জীবনে কয় অনেক ঘাটের পানি খেয়েছেন। জন্মেছিলেন কঠিন এক পরিবেশে। তার চার বছর বয়সে বাবা রোগে ভুগে মারা যান। এর কয়েক বছর পর সৎবাপ নিহত হন কলম্বিয়ান গেরিলাদের হাতে। বয়সকালে আর্মিতে ঢুকে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ফার্ক-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন কয়। কিন্তু কাজটার নিয়মনীতি পছন্দ হয়নি বলে বাহিনী ছেড়ে দেন তিনি।
কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর কয়ের ইচ্ছে হলো ইরাকে গিয়ে যুদ্ধ করার। কিন্তু গার্লফ্রেন্ড সন্তানসম্ভবা হওয়ায় সেমুখো আর হননি তিনি। তাদের একটি মেয়ে হয় — জীবনের নতুন মোড় কয়ের জন্য। প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর হিসেবে ভালোই চলছিল তারপর, মাসে পাঁচ হাজার ডলার বেতন পেতেন। এ অর্থে দিব্যি খেয়েপরে চলা যেত। কিন্তু কাজে বাঁধা পড়ার জন্য সেটা পর্যাপ্ত ছিল না। বছর তিনেক আগে মাদ্রিদ থেকে কয়ের এক তুতো ভাই ফোন করে স্পেনে অভিবাসনের জন্য কানপড়া দিলেন।
তরুণ লাতিন আমেরিকানদের যদি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে সেটা কাজে লাগিয়ে টু-পাইস রোজগার করা যায়। কয়েক দশক ধরে ফার্ক গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বদৌলতে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীতে অনেক সেনারই যুদ্ধের, বিশেষ করে গেরিলা লড়াইয়ের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়া মাদক চোরাচালানবিরোধী অভিযানের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি মার্কিন প্রশিক্ষণও রয়েছে তাদের।
যুদ্ধের ময়দানে এখন পর্যন্ত টিকে আছেন কয়, কিন্তু তার অনেক সহযোদ্ধা আরও আগেই ভূপাতিত হয়েছেন। এল পাইস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একের পর এক অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকেন তিনি। সেই শুরুর প্রশিক্ষণ থেকে কোনোক্রমে বেঁচে ফেরা ইয়াভোরিভ সামরিকঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ, অথবা খারকিভের সফল পালটা আক্রমণ বা দনবাসের সেভেরস্কি দনেৎস নদীর তীরে লড়াই — তার অভিজ্ঞতার ঝুলি যেন অফুরন্ত।
এরিক ছিলেন কয়ের লড়াইয়ের সঙ্গী, একটি কোম্পানির লিডার। তাকে দেখে মনে হতো তিনি অপরাজেয়। তারপর একদিন খবর এল, ল্যান্ডমাইনের ফাঁদে পড়েছেন এরিক। তবে তার মৃত্যু মাইনের আঘাতে হয়নি। উদ্ধারের সময় রুশ গাইডেড মিসাইলের আঘাতে নিহত হন এরিক।
যুদ্ধের মাঝে কিছুটা ছুটি পাওয়া যায়। এরকম এক ছুটিতে কয় একবার খারকিভ গিয়েছিলেন। অনেক খুঁজে একটি হোটেল পেলেন। সেখানে থাকার সময় ক্যাটরিনা নামক এক রিসেপশনিস্টের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার। বছরখানেকের মধ্যে তারা বিয়েও করেন। কয়ের ভাষায়, ইউক্রেনে কিছু একটা বদলে গেছে। 'মানুষ এখন দিন হিসেবে বাঁচতে চায়,' বলেন তিনি।
তবে আবারও রণাঙ্গনে নিজের ব্রাভো ইউনিটে ফিরতে হয় কয়কে। নিয়মিত অভিযান, লড়াইয়ে দিন কাটে। কিন্তু গত অক্টোবরে তার মধ্যে নতুন এক উপলব্ধি তৈরি হয়। 'এখানে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মানে একটা বিষয় নিশ্চিত: মৃত্যু,' বলেন কয়। কেউ হয়তো ভাববেন, কয় কীভাবে এতদিন বেঁচে রয়েছেন। মাঝেমধ্যে সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে ফিরে আসাটা স্রেফ ভাগ্যের জোরে হয়েছিল।
গত সপ্তাহে ক্যাটরিনাকে নিয়ে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন কয়। ক্যাটরিনা এখন কয়েক সপ্তাহের সন্তানসম্ভবা। স্পেনে নতুন জীবন শুরু করতে চান তারা। 'আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, তার ভার অনেক। এখন আমি বিশ্রাম করতে চাই। আর যুদ্ধের ইচ্ছে নেই, জীবনে অনেকবারই তো মৃত্যুকে ফাঁকি দিলাম,' বলেন পোড়খাওয়া এ যোদ্ধা।
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত