লোহিত সাগর সংকট সোমালি জলদস্যুদের ভারত মহাসাগরমুখী করেছে
গত ১৫ মার্চ আরব সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার ড্রোন ব্যবহার করে নিশ্চিত হয়, সশস্ত্র দস্যুরা এমভি রুয়েন জাহাজটিকে ছিনতাই করেছে। এরপর একটি পেট্রোল জাহাজ, ড্রোন, নজরদারি বিমান এবং সেনা কমান্ডোদের ব্যবহার করে ৪০ ঘণ্টার পালটা আক্রমণ চালানো হয়। শেষপর্যন্ত ছিনতাইকারীরা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তি পায় মালটার পতাকাবাহী জাহাজটি ও এর নাবিকেরা।
সোমালি জলদস্যুরা এমভি রুয়েন জাহাজটি ছিনতাই করেছিল। কুখ্যাত এ জলদস্যুরা গত কয়েক মাসে আবারও আরব সাগরে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। লোহিত সাগরে বাণিজ্য জাহাজে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে ওই নৌপথের জাহাজগুলো বর্তমানে আরব সাগর ব্যবহার করে যাত্রা করছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছে সোমালি জলদস্যুরা।
গত তিনমাসে ৩টি বড় বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে সোমালি জলদস্যুরা। সবমিলিয়ে ১৮টি ছোট নৌযানে আক্রমণ করেছিল সোমালি জলদস্যুরা। এর মধ্যে প্রায় ৭টির নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলদস্যুবিরোধী নৌ-অভিযান আটালান্টা'র তথ্যমতে, আরও অনেক জাহাজ সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড ও ছিনতাইয়ের চেষ্টার কথা জানিয়েছে। অপারেশন আটালান্টা কেবল ভিক্টোরিয়া নামক একটি স্প্যানিশ ফ্রিগেট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
বৈশ্বিক সামুদ্রিক নৌচলাচলের ১৫ শতাংশ পরিচালিত হয় দক্ষিণ লোহিত সাগরে। এ অঞ্চলে হুথিদের হামলার কারণে বাধ্য হয়ে বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো এখন ঘুরপথে আফ্রিকার পাশ দিয়ে তাদের জাহাজগুলো পরিচালনা করছে। ইয়েমেন ও জিবুতির মধ্যকার বাব এল-মান্দেব প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের হার দ্রুত কমে গেছে। অন্যদিকে উত্তমাশা অন্তরীপের পাশ দিয়ে জাহাজ গমনের হার ৯০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছে, নৌবাণিজ্যের ওপর নজর রাখা প্ল্যাটফর্ম পোর্টওয়াচ।
এক দশক আগে সোমালি জলদস্যুরা যতটা হুমকির কারণ ছিল, বর্তমানে আর তা নেই বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ২০১১ সালে সোমালি জলদস্যুরা সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল। সে সময় তাদেরকে মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক একটি মেরিটাইম বাহিনীও তৈরি করা হয়।
এরপর জলদস্যুতায় লাভ কমে গেলে তাদের অনেকেই এ পথ ছেড়ে দেয়। তবে লোহিত সাগর সংকটের মাঝে সোমালি জলদস্যুদের এ উত্থান নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
২০১২–২০১৪ সালে আরব সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল শেখর সিনহা বলেন, 'লোহিত সাগরে হুথিরা আক্রমণ শুরু করার পর থেকে জলদস্যুতার ঘটনা বড় আকারে বেড়ে গেছে। হুথিরা আক্রমণ শুরু করার আগে এ দস্যুবৃত্তি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল।'
বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীগুলোর অনুমান, সোমালিয়ার পন্টল্যান্ড থেকে বর্তমানে চারটি পর্যন্ত জলদস্যু দল দস্যুবৃত্তি পরিচালনা করছে। মাছ ধরার ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত এ অঞ্চল সোমালি গৃহযুদ্ধের কারণে দীর্ঘসময় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। বিদেশি কোম্পানিগুলোও এখানকার উপকূলে মাত্রাতিরিক্ত হারে মাছ আহরণ করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পন্টল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেড়েছে, যা দস্যুতা বাড়াতে প্রভাব রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রিস্ক ইন্টেলিজেন্স নামক সামুদ্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকিবিষয়ক পরামর্শদাতা একটি প্রতিষ্ঠানের বোরের লুইস বলেন, মূলত দুই ধরনের জলদস্যু হামলা হয়: সোমালি উপকূলের কাছে অবৈধ মাছধরার নৌকার ওপর হামলা এবং গভীর সমুদ্রে বাণিজ্য জাহাজ ছিনতাই।
প্রথম ধরনের হামলার পেছনে থাকে সোমালি জেলেদের ছোট ছোট দল। অন্যদিকে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে দলবদ্ধ ও অভিজ্ঞ জলদস্যুরা, যাদের সঙ্গে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর আঁতাত থাকে প্রায় সময়।
এ দ্বিতীয় পক্ষটি সাধারণত আগে ছিনতাই করা জাহাজকে মূল জাহাজ (মাদারশিপ) হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও উন্নত নেভিগেশন ব্যবস্থা থাকে।
জলদস্যু মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখিয়েছে ভারত। আরব সাগরে এটি সর্ববৃহৎ নৌ উপস্থিতি তৈরি করেছে।
ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সরকারগুলোর সংগঠন ইন্ডিয়ান ওশেন কমিশন-এর রাজ মহাবীর জলদস্যুতা বৃদ্ধির প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'এখন আমাদেরকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দেখতে হবে ভারত যা করছে, তা নতুন নতুন জলদস্যু হামলা ঠেকাতে পর্যাপ্ত কি না।'