সোমালিয়ার জেলেরা যেভাবে জলদস্যু হয়ে উঠল
গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে এমভি আবদুল্লাহ নামক একটি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালি জলদস্যুরা। চট্টগ্রামের কবির (কেএসআরএম) গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন এ জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ'র নাবিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে কবে তাদের উদ্ধার করা যাবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
২০১০ সালেও একই শিপিং কোম্পানির মালিকানাধীন এমভি জাহান মনি সোমালি জলদস্যুদের ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল। ওইসময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। ১০৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর ওই ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনা হয়।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী শ্রুত। কিন্তু দরিদ্র এ দেশটির অনেকের দস্যুবৃত্তিকে প্রায় পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
জীর্ণ পোশাক, ভারী অস্ত্র, জিপিএস ফোন — তাদের এ বেশভূষা দেখে মনে করার উপায় নেই তারা কেবল মরিয়া হয়ে দস্যুবৃত্তির পথে নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সোমালিয়ায়, বিশেষ করে সোমালি উপকূলে যথাযথ আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি না থাকারই সুযোগ নেয় এ জলদস্যুরা।
তবে টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সোমালিয়ায় করুণ পরিস্থিতির সুযোগ কিন্তু কেবল এ জলদস্যুরাই নেয়নি। বরং বাকি বিশ্বের অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতাও এ দস্যুবৃত্তি উত্থানের একটি অন্যতম কারণ।
১৯৯১ সালে গৃহযুদ্ধের ফলে সোমালিয়ায় সর্বশেষ কার্যকর সরকারটিরও পতন ঘটে। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় উপকূলের মালিক সোমালিয়া। সরকারি বিধিনিষেধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় তিন হাজার ৩৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রে বিদেশি নৌযানের লুটাপাটের বিপুল নজির রয়েছে।
সেই ২০০৬ সালেই জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সোমালিয়ায় কোনো সক্রিয় কোস্টগার্ড না থাকায় দেশটির জলসীমায় এসে বিদেশি নৌযান মাছ ও সিফুড আহরণ করে নিয়ে যায়। আর প্রতি বছর সোমালিয়ার সমুদ্র থেকে কেবল ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরই সিফুড লুট করে বিদেশি গোষ্ঠীগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছিলেন উপকূলীয় এলাকায় বাস করা সোমালি জনগণ। নিজেদের সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে তাদেরকে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হতো বহিঃশত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে। এভাবে বিদেশি ট্রলারের হামলা থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯০-এর দশকে সোমালিয়ায় প্রথম জলদস্যুদলের বিস্তার ঘটে।
কোনো একসময়ে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, স্পেনের মতো দেশের মাছ ধরার ট্রলারও সোমালিয়ার জলসীমায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যেত। বলা বাহুল্য, এসব ট্রলারের সোমালি উপকূলে মাছ ধরার কোনো বৈধতা বা লাইসেন্স থাকত না। প্রায় দুই দশকের মতো সময় সোমালিয়ার সমুদ্র এলাকায় এভাবে শোষণ চালিয়েছে এসব বিদেশিরা।
এ ধরনের অবৈধ ট্রলার সোমালিদের জলদস্যু হওয়ার পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অতীতে এসব ট্রলার আটক করার পর দ্রুতই মুক্তিপণের অর্থ পেয়ে যেত দস্যুরা। কারণ বিদেশি এসব গোষ্ঠীগুলোও চাইত না তারা যে আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন করেছে তা প্রকাশ্যে আসুক।
এভাবেই ছোট ছোট ট্রলার জিম্মি করার মাধ্যমে নিজেদের কৌশলগত নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলে দস্যুরা। একসময় মাছ ধরার ট্রলারের পাশাপাশি পণ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের দিকে নজর পড়ে তাদের।
এছাড়া দারিদ্র্য, অরাজকতা, আইনের শাসনের অভাবের পাশাপাশি গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা, সহিংসতাও এ ধরনের অপরাধের পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে।
শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকায় এ জলদস্যুরা দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপরই ছড়ি ঘোরাতে পারে। মুক্তিপণের টাকা বিনিয়োগ করে নিজেদের অপরাধের পরিসরও বাড়ায় তারা। বেকার সোমালি তরুণদের বড় অঙ্কের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজেদের দলে ভেড়ায় এ জলদস্যুরা।
তবে গত ১৫ বছর ধরে সোমালি উপকূলে দস্যুবৃত্তি কমানোর চেষ্টাও কম হয়নি। ছয়টি আন্তর্জাতিক শিপিং প্রতিষ্ঠান মিলে ২০১২ সালে ঘোষণা দেওয়া হয়, সোমালি উপকূলে জলদস্যু সমস্যা বৈশ্বিক শিপিংয়ের জন্য আর কোনো ঝুঁকি নয়।
২০২৩ সালেও সংস্থাটি জানায়, ভারত মহাসাগরেও দস্যুবৃত্তির আর বড় ঝুঁকি নেই। কারণ ২০১৮ সালে সোমালি জলদস্যুরা এ মহাসাগরে আর কোনো আক্রমণ চালায়নি। কিন্তু এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের পর আফ্রিকার এ সমুদ্রপথটি দিয়ে বাণিজ্য আবার ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলো।