উনিশ শতকের এই লেটারপ্রেসটি এখনো সচল, চলছে ছাপার কাজ
নীলক্ষেতের বাণিজ্য বিতান সুপার মার্কেটে হরেক রকমের দোকান। শশব্যস্ত এ মার্কেটের নিচতলায় ডি/৭২ নম্বর দোকানটি খুঁজে পাওয়া তাই বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে একবার খুঁজে পেলে সেখানে যা দেখতে পাওয়া যায়, তার তুলনায় এ কষ্টটুকু সামান্যই। বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা গভীর আগ্রহে খুঁজে ফেরেন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য!
৭২ নম্বর দোকানটি আসলে একটি ছাপাখানা। আয়তনে ক্ষুদ্রাকায়। আর তাতে একটি মাত্র ছাপার যন্ত্র। সেটিও আজকের যুগের আধুনিক কোনো যন্ত্র নয়, উনবিংশ শতকের একটি লেটারপ্রেস! দেখে মনে হয় যেন ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে স্থান করে নিয়েছে দোকানটিতে।
যন্ত্রটি এখনও সচল। এতেই সকাল-বিকেল একের পর এক ছাপা হচ্ছে ব্যাংকের চেকবইয়ের নাম্বার, ভিজিটিং কার্ড কিংবা রশিদ বই। বাংলাদেশে যে গুটিকয়েক লেটারপ্রেস এখনও টিকে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। ঢাকায় বাণিজ্যিকভাবে সচল লেটারপ্রেস হিসেবে এটিই সর্বাধিক পরিচিত।
প্রেসটির মালিক মুদ্রাকর হালিম হোসেন। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। মানিকগঞ্জের লোক। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ঢাকায় এসেছিলেন এই ছাপার কাজেই। ৮০০ টাকা মজুরিতে অন্যের দোকানে কাজ করতেন সেসময়। ১৯৯৬ সালে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে একটি লেটারপ্রেস কেনেন তিনি। শুরু হয় তার নিজস্ব প্রেসের যাত্রা। শুরুতে দোকান ছিল লালবাগে। তারপর আসেন হাতিরপুলে। সেখানে ব্যবসা ভালো না চলায় সর্বশেষ থিতু হন নীলক্ষেতে এসে। দোকানের নাম দেন 'একতা লেটার প্রেস'।
এখনও সেই লেটারপ্রেসটিই তার অবলম্বন। নীলক্ষেত-কাঁটাবন অঞ্চলের প্রেসগুলোতে যখন আধুনিক মেশিনের জয়জয়কার, তখনও তিনি পড়ে রয়েছেন শতাব্দী-পুরাতন এই যন্ত্রটি নিয়ে। যে গুটিকয়েক কাজ তিনি পান, তা শেষ করতেই দিনের বেশিরভাগ সময় চলে যায়। আয় হয় সামান্যই। কিন্তু লেটারপ্রেস আর ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসায় এখনও টিকে রয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকায় ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অনুষ্ঠিত হয় ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। খ্যাতিমান শিল্পী ও গবেষক সব্যসাচী হাজরার উদ্যোগে প্রদর্শনীটির নাম ছিল 'প্রাইমার টু প্রেস'। প্রথমদিকের ভাষা শিক্ষার বইগুলো ও তার মুদ্রণ কৌশল তুলে ধরা হয় এতে। আর এ প্রদর্শনীতেই নিজের লেটারপ্রেস নিয়ে অংশ নেন হালিম হোসেন। ফলে প্রাচীনকালের ছাপার কৌশলগুলো সরাসরি দেখার সুযোগ পান দর্শনার্থীরা।
বিভিন্ন সময়ের বাংলা প্রাইমার [ভাষা শিক্ষার বই] নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন সব্যসাচী। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন, সেকালের বেশিরভাগ বই ছাপা হয়েছিল লেটারপ্রেসে। নতুন প্রজন্ম যাতে সে ঐতিহ্যকে জানতে পারে, বইগুলোর ছাপার পেছনের পরিশ্রম, মেধা বুঝতে পারে; সে উদ্দেশ্যেই প্রিন্টার হালিম হোসেনকে খুঁজে বের করে প্রদর্শনীতে যুক্ত করেন তিনি।
জানা যায়, হালিম হোসেনের ব্যবহৃত যন্ত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের চ্যান্ডলার অ্যান্ড প্রাইস কোম্পানির তৈরি। ব্যাংকার হ্যারিসন চ্যান্ডলার এবং উইলিয়াম প্রাইস ছিলেন এ কোম্পানির মালিক। ১৮৮১ সালে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের ক্লেভিল্যান্ডে একটি কারখানা স্থাপন করেন তারা। ১৯৮৪ সাল নাগাদ ৩০০টির মতো প্রেস তারা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে অফসেট প্রিন্টিং প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটলে কোম্পানিটির কার্যক্রম আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।
সব্যসাচীর মতে, হালিম হোসেনের যন্ত্রটি সরাসরি বাংলাদেশে আসেনি। তিনি অনুমান করছেন, দীর্ঘদিন কলকাতায় ব্যবহৃত হয়েছে এ ছাপার যন্ত্রটি। তারপর তা বাংলাদেশে আসে। তবে সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে নয়। '৭১-এর আগেই তা ঢাকায় এসেছে বলে তার মত।
বর্তমানের এ যন্ত্রটি বেশ কয়েকবার সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে প্রেসটি ছিলো পায়ে চালিত, তাতে যুক্ত ছিল একটি প্যাডেল। পরবর্তীতে তা কেটে বাদ দেয়া হয়। এরপর এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় বিদ্যুৎচালিত ইঞ্জিন। তবে দিন দিন লেটারপ্রেসের চাহিদা কমতে থাকায় একসময় এর ওপরের অংশও কেটে ফেলা হয়। ফলে পরবর্তীকালে এ যন্ত্রগুলো বড় কোন ছাপা কাজ নয়, বরং ব্যবহৃত হতে থাকে ছোটখাটো কিছু কাজের জন্য, বলছেন সব্যসাচী হাজরা।
যন্ত্রটির বিভিন্ন অংশের বর্ণনা পাওয়া গেল হালিম হোসেনের কাছে। ওপরের লোহার চ্যাপ্টা অংশটিকে বলা হয় শিল। সেখানে ছাপার কালি দেওয়া হয়। এরপর রোলার ঘুরলে সে কালি এসে লাগে প্লাস্টিক অথবা পিতলের তৈরি লেটার বা ব্লকে। সেই ব্লক এসে কাগজে স্পর্শ করলেই সেখানে ফুটে ওঠে ডিজাইন।
এক কালে এ ধরনের যন্ত্র দিয়েই হয়েছে ভারী ভারী সব কাজ, ছাপা হয়েছে বই-পুস্তক-পত্রিকা। হালিম হোসেন জানালেন, এখন আর সেসব কিছু হয় না। 'একটা সময় গেছে, এটা দিয়ে মনে করেন যে বই, প্রশ্ন, নির্বাচনের পোস্টার, সম্পূর্ণ কাজই হইতো। আমি নিজেই গ্রামীণ ব্যাংকের যাবতীয় চেকবই করতাম।'
এখন বিভিন্ন আধুনিক ছাপাখান এ বাজারে আধিপত্য চালাচ্ছে। 'ঢাকা শহরের এই মেশিন আর নাই, তাই মোটামুটি কিছু কাজ আসে। বড়বড় প্রতিষ্ঠান আর আমার কাছে কাজ দেয় না। ছোটখাটো কাজগুলো পাই,' বললেন হালিম।
বর্তমানে এ যন্ত্র দিয়ে মূলত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেকবই, রশিদ বা স্লিপের সিকিউরিটি নম্বরগুলো ছাপার কাজ করেন হালিম হোসেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটও তিনি করে থাকেন। এছাড়াও কেউ কোনো কাস্টমাইজড ডিজাইনের ভিজিটিং কার্ড, চিঠির খাম, বিয়ের কার্ড করাতে চাইলেও তা করে দিতে পারেন তিনি। সেক্ষেত্রে ডিজাইন অনুযায়ী প্লাস্টিক অথবা পিতল দিয়ে ব্লক তৈরি করতে হয়। যে কারণে খরচও বাড়ে অনেক।
তা খরচ কেমন পড়ে? 'খরচ হয় ডিজাইন অনুযায়ী। এখনকার মেশিনগুলার থাইকা বেশির খরচ। ব্লক প্লাস্টিকের হয়, স্টিলের হয়, পিতলেরও হয়। ব্লকটাতেই অতিরিক্ত পয়সা চইলা যায়,' জানালেন হালিম।
'লেখাটা, ডিজাইন দিলেই সব কাজ কইরা দেয়া সম্ভব। এক হাজার পিস ভিজিটিং কার্ড করাইতে হইলে আড়াই হাজার টাকার মতো খরচ হইবো। সাইজের ওপর খরচ,' বলেন এ মুদ্রাকর।
একদিকে অর্থসংকট অন্যদিকে লেটারপ্রেসের প্রতি ভালোবাসার কারণে আধুনিক যন্ত্র কেনার কথা কখনো ভাবেননি হালিম। তবে ব্যবসার মন্দা অবস্থায় টিকে থাকাই দায়, বলছেন তিনি। 'ব্যবসা তো এখন একেবারে নাই বললেই চলে। আমাগো মতো মানুষ টিকে থাকাই কষ্ট, এই মেশিনও ধইরা রাখাও কষ্ট। বিদ্যুৎ খরচ, কালি লাগে, কেরোসিন লাগে, মবিল লাগে, তারপর যদি কিছু অবিশিষ্ট থাকে, সেটাই লাভ।'
তার পরিবারের কেউ আর এই ব্যবসায় আসবে না, এমনটাই ধারণা হালিমের। তবে তার মতে, এই মেশিন চাইলে আরও একশ বছর সচল রাখা সম্ভব। ঐতিহ্যের কথা ভেবে কেউ যদি সংরক্ষণ না করেন, কিংবা তার ব্যবসা টিকে না থাকে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে জাদুঘরে গিয়েই দেখতে হবে প্রাচীন এই ছাপার কৌশল, বললেন প্রিন্টার হালিম হোসেন।