কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো
উড়োজাহাজের ভেতর কখনো নোয়াহ-খেকো মাছের পেটের মতো অন্ধকার নামে। সব চুপচাপ। একটি কোনো দুরন্ত শিশুর সামান্য কান্না। মায়ের ফিসফাস। তেমন অন্ধকারে ভাসতে ভাসতে মনে হয়, আব্বা না-কি এখন রুহমাত্র? মাগফেরাতকামী রুহ? পরীক্ষার হলের সামনে ভিড়ের উপর দিয়ে দেখা যাওয়া মাথাটা নয়, বিমানবন্দরে সবচেয়ে উল্লসিত অধীর আগ্রহী মুখটা নয়, পাবলিক একজ্যামের আগের রাতের পোতাশ্রয় বুকটা নয়, বনিএমের গান বাজিয়ে লাফালাফি করে নাচা আর 'ওহ দৌজ রাশানস' বলে লুটিয়ে পড়া মস্ত মস্ত হাড়ে গড়া শরীর নয়, একটি দন্ডায়মান বিপত্তারণ পাহাড় নয়–ইশতার গেটের সিংহটা নয়, সমস্ত পরীক্ষার আগে সকালে আপনা থেকে জেগে তেলাওয়াতের অজেয় আওয়াজ আর নয়। আব্বা না-কি অনেককাল আগ থেকেই কেবল রুহমাত্র?
আমার আব্বার সবচেয়ে প্রিয় গানটা শুনতে ইচ্ছা করে, বুকফাটা তৃষ্ণা পায়। রফিসাহাব আব্বার সবচেয়ে প্রিয়, মুহম্মদ রফির 'খোয়া খোয়া চান্দ, খুলা আসমান'। এরোপ্লেনের বিনোদনসংগ্রহে রাখমানিনভের 'গ্রেইভ' থেকে শুরু হয়ে হৃদয় খান অব্দি কত কিছু আছে, খয়াটে সেই চান্দ নেই। খোয়া গেছে। অরিজিৎ সিং প্রেমের গান গাইছেন—আচ্ছা চলতা হু। গানটা আব্বার মতো–অন্ধকার দরিয়ার পিচ্ছিল নীল মাছের মতো লাফ দেয় — আন্ধেরা তেরা ম্যায়নে লে লিয়া, মেরা উজলা সিতারা তেরে নাম কিয়া। ওরকম উজ্জ্বল কোনো সওদার পর লেনাদেনার পর আব্বা ঘুড্ডির মতো ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে।
কয়েক সারি সামনের ব্যাসিনেটে কোলের শিশুকে শুইয়ে রেখে একটি তরুণী মা আমার দিকে সাতরে আসে, তার চোখ সোনালি চাউনি সোনালি। তাকে দেখতে খ্রিস্টের বাহন অফেরোর মতো।
-আমি টের পেয়েছি তুমি কাঁদছ, কেন কী হয়েছে তোমার?
সোনালি হাতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। সে না-কি পাকিস্তানের মিরপুরের মেয়ে? যে দেশের কোনো কিছু আমি স্পর্শ করি না? হৃদয়ের সিন্দুকে শুধু 'আচ্ছে কাম' পুরে রেখে যেতে বলে আব্বা চলে যাচ্ছে। আমি সেই সিন্দুকের ডালায় হাত রাখি, মেয়েটির সোনালি চুলে, সে আমাকে আদর করে বলে, সমস্ততেই নাকি আব্বা আছে আর থাকবে।
কুশান আমার দিকে হেলে ঘুমাচ্ছে, কান্নার সামান্য শব্দেও সে ঘুমের ভেতর আমাকে জড়িয়ে ধরে। জেগে ওঠে। তাকে তার বাপ বলে দিয়েছে, মায়ের দেখভাল কোরো। সে আমাকে ডেকে অবাক গলায় বলে, 'জানালায় তাকাও।'
দেখি অন্ধকার কেটে সুরমা নীল বিশাল মেঘের স্তূপের কিনারায় কমলা আভা দেখা দিয়েছে, কমলার তলায় জরির টান, সোনালি। আশ্চর্য সকাল। এমন কোনো সকালে অনেক দিন আগে আমি তুলতুলে কুশকে বুকে নিয়ে টাইগ্রিস ইউফ্রেটিসের ওপর সূর্যোদয় দেখেছিলাম, প্লেনের জানালা থেকে মহামহিম পাহাড়গুলোকে কেমন তেরপল ঢাকা ভাজ মনে হয়েছিল! কুশানের সমস্ত মুখ কান গলা সোনালি আরকে ডুবিয়ে দিয়ে সকাল হচ্ছে, পশ্চিমে নয় পূবের দিকে, কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে...
যে সকাল নিঃস্ব, যে দিনে আর 'বুড়ি তোর জন্য তপসে মাছ এনেছি' নেই, তেমন দিন কী করে সোনালি হতে পারে?
বাবা চলে যাবার কয়েকদিন আগে একরাতে লন্ডনে আমরা 'ডেভিড অ্যান্ড বাথশেবা' (১৯৫১) দেখছিলাম। বিপন্ন, যুদ্ধবিপর্যস্ত ডেভিড (গ্রেগরি পেক) জেরুজালেমের মন্দিরে ঢুকে পবিত্রতম আর্কের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসেছেন। প্রজাসাধারণ তাঁর ব্যভিচার এবং অন্যান্য অপরাধের বিচার চায়। ডেভিড প্রার্থনা করছেন তাঁর সেই প্রথম যৌবনের ঈশ্বরের কাছে, যিনি সর্বদ্রষ্টা–স্বচ্ছদ্রষ্টা। প্রারম্ভিক সেই জীবন থেকে ডেভিড বেঁকে গেছেন এক অন্যায়-অবিচারে পূর্ন জীবনের দিকে, তাঁর রক্তধারা কলুষিত হয়েছে, প্রজা পীড়িত হয়েছে। ধুলি, তস্য ধুলি হয়ে মিশে গেছেন নীচে, নীচতায়… এর পরপরই গ্রেগরি পেক আশ্চর্য নম্র গলায় বলেন, And yet, O God, I am also Thy creation. Thy Holy Spirit abode with me in the wilderness. তবুও তো আমি তোমারই সৃষ্টি! প্রিয়তমা বাথশেবাকে ডেভিড আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, ঈশ্বর শুধু অন্যায় আর শাস্তির নয়, তিনি অবারিত সুন্দরের, ক্ষমার, দানের আর প্রাপ্তির। 'Look not on the sinner, who comes before Thee; but on the boy he was, who loved Thee, and who would have died for Thee' — এ অধমের দিকে চেয়ো না, চাও সেই বালকের দিকে যে তোমায় ভালোবাসতো, যে তোমার তরে প্রাণ দিতেও পিছপা হতো না… আশ্চর্য সুন্দর সেই দীর্ঘ সংলাপ।
প্রতি রাতের এক পর্যায়ে আমি আব্বার গলার তেলাওয়াত শুনতে পাই, প্রায়ান্ধকার ঘরটাকে সোনালি ক্যালিগ্রাফিতে ভরে দিচ্ছে। সমস্ত পরকালপরায়ণতার, দুঃসহ শাস্তির আশ্বাসের বিপরীতে কিশোর ডেভিডের সেই নরম মসৃণ আলোয় ভরা ঈশ্বর তাঁর অমৃতসদনে মানুষকে টেনে নিচ্ছেন। আজ সকালে আমি রাজা ডেভিডের সেই অনুনয়ভরা স্বরের কথা মনে করে জাগলাম। কুশান সময়ের তফাত আর ল্যাটিচিউড নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, এত জটিল করে তুলছে, তাকে সহজ করে বল্লাম—টাইম ইজ রাইপার ইন দ্য ইস্ট। দ্য মোর ইউ গো টুওয়ার্ডস দ্য ইস্ট।
সে ভারী খুশি হয়ে গেল, এত সহজ হয়ে গেল সব! তারিফ করে বল্লো, 'ওরকম একটা কথা কেবল তুমিই বলতে পারো, টাইম ইজ রাইপার।'
সময় পেকে যাবার ব্যাপারটা আমি বহুবার টের পেয়েছি যে! দুঃসময়ে সময় কেমন পেকে টনটন করে, প্রজেক্ট জমা দেবার রাতে সময় কেমন পাকা ঢেঁড়সের মতো ঝুনঝুন করে। কিন্তু সিনেমায় পেকে বিষিয়ে যাওয়া দুঃসময়ে ডেভিডের পরমেশ্বর তাঁকে আত্মবলি দিতে দেননি, তিনি ক্ষমার রুপালি বৃষ্টি নামিয়েছিলেন। আমার সকাল হলো তেমন রুপালি। কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে তেমন আভাস। মার্চে যে ছাদটায় আমি গোলাপি মঞ্জরীর ফুল দেখে গেছিলাম, সেই ছাদে মনসায় নতুন পাতা এসেছে।
আম্মা এসে আমাকে নিচু গলায় বল্লো, 'কাল যে তোমার রাস্তায় তালশাঁস দেখে তোমার বাবার কথা মনে পড়েছে, জানো কয়েকদিন আগেই তোমার বাবা অনেকগুলো তালশাঁস কিনে এনেছিল, উনার তো খুব প্রিয় ছিল। আমি কিছু ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম। চলো খাবে।'
মুহূর্তে আমি দেখতে পেলাম কচি তালের কাঁদি, মাথা কামানো পাগলি এবং গোরস্তান, তাপদাহে কম্পমান দিগন্তে কারা যেন গোর খুঁড়ছে — সূর্য ঝলসাচ্ছে তাদের পিঠে। ডেভিডের ঈশ্বর দপ করে নিভে গেলেন, কিন্তু আবার দেখলাম গলিত মোমের মতো রঙ তালশাঁস, আম্মা বাটিতে করে এনেছে। আকাশের রঙও আজ ওরকম। কুশানেরটায় মোটা দানার চিনি ছড়িয়ে দিলাম, রবীন্দ্রনাথ কোথাও লিখেছিলেন মিছরিচূর্ণ দিয়ে তালশাঁস পরিবেশনের কথা?
আম্মাকে রান্নাঘর থেকে বিদায় করে দিতে গেলাম, আম্মা গেল না। বিষন্ন মুখে বল্লো, 'জানো না-কি তোমার বাবা কদিন আগেই অনেক তপসে মাছ এনেছিল, ফ্রিজারে আছে। অত মাছ এনে বরফে রেখে দিতে দিতে বলেছিল, আহা মেয়েটা যদি খেতে পারতো! অথচ নিজে খেতে পারেনি আর!' আমার মাথা ফাঁকা করে দিয়ে আম্মা বলতেই লাগলো, 'আমি বল্লাম ও আর কবে আসবে, কবেই বা এই মাছ খাবে! কে জানতো তুমি আসবে?'
এখনো এ বাড়িতে আব্বার বাজার আছে, আব্বার গায়ের ফতুয়া পরে কুশান ঘুরছে, আব্বার সমস্ত ব্যবহার্য জমে আছে। আমি বললাম, আচ্ছা আমরা সেই মাছ খাবো।
খেলাম। মাছের ঝোল মুখে দিয়ে মনে মনে বললাম, বাবা খাও।
বারান্দায় আজ আবার উদ্বিগ্ন টিয়াপাখি এসে হাজির। আব্বা তাকেও খাবার দিয়ে গেছিল। সে শুধু আব্বার মৃত্যুদিনে আসেনি না-কি। আজ সে নাক ডুবিয়ে সমস্ত বীজ খেয়ে আর ঠোঁটের ঘষায় তুষটুকু উড়িয়ে গেল। কি নির্ভয়, যেন নিজের বাড়িতে এসেছে।
দুপুরে কিছু কাছের মানুষের ফোন এলো, বিকেলে কিছু কাছের মানুষ এলো। মায়ের কাছে আব্বা চলে যাবার প্রতিটি মুহূর্ত রহস্যময়, মা বারবার সেই মুহূর্তগুলো ঘুরে আসে। সবাই চলে গেলে আবার অন্ধকার হয়ে গেল সব। রাতে আমি আর আম্মা বসে বসে কথা বলছি, গলিপথে ভীষণ শোরগোল শুরু হলো। বারান্দায় গিয়ে দেখি রাস্তায় নীল প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা আর অজস্র মানুষ গলগলিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকছে। সামনে এসে থেমেছে একটা মিনি ট্রাক। ট্রাকে নীল ঝুড়িতে কমলা ফল। আরো ঠাহর করে দেখি, ওটা একটা চাদর, নীলের ওপর কমলা চক্র কাটা নকশা, হায় ঈশ্বর ওটা চাদরে মোড়া লাশ আর খাটিয়া। মানুষের কাঁধের ঢেউয়ে চড়ে সেই লাশ বাড়ির ভিতর ঢুকলো, মহাপ্রলয়ের শব্দের মতো মানুষের কান্না শুরু হলো। তারপর যেভাবে ঢুকেছিল, সেভাবেই আরেক ঢেউয়ে (মানুষের ঢেউ, কান্নার ঢেউ) সওয়ার হয়ে লাশটা বাড়ি থেকে বের হয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেল, কিছুক্ষণ ইতস্তত করে খালি ট্রাকটা পূবের দিকে চলে গেল। কান্না আর আহাজারি কিন্তু থামলো না বহুক্ষণ। মানুষের কান্নার আওয়াজে আমার বরাবর চোখ ভেসে যায়, আমিও ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলাম। জানলাম না কে গেল, কীসে গেল, শুধু জানলাম — কারও গেল।
এ গলিপথে মৃত্যু এক চকমকি নিয়ে ঢুকেছে (মোমের ফুলের মতো জীবন ফুটে ছিল), যেদিকে যাচ্ছে ফুলকি জ্বলে উঠছে।