যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ
গমের বৈশ্বিক দুই নির্ভরযোগ্য উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চললেও বাংলাদেশ গম আমদানির সিংহভাগ এ দুটি দেশ থেকে নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর একপর্যায়ে গমের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উৎস ভারত খাদ্যশস্যটির রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে গম আমদানি আরও জটিল হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী দেশটি এখনো এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে।
গমের মোট আমদানি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেড়ে পাঁচ বছরের শীর্ষে দাঁড়িয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে গম আমদানি ৬৮ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে, যার প্রায় ৫০ শতাংশ রাশিয়া থেকে সরকারিভাবে এবং বেসরকারি আমদানিকারক উভয় মাধ্যমে হয়েছে।
সরকারিভাবে আমদানি হওয়া গমের প্রায় সাড়ে আট লাখ মেট্রিক টনের উৎসদেশ রাশিয়া। বাকিটুকু এসেছে ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও উরুগুয়ে থেকে।
এর ফলে ভারতীয় গমের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা থেকে কিছুট স্বস্তি পাওয়া গিয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে ভারত গম রপ্তানিতে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা দিলে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি পড়ে দেশের গম সরবরাহ। এর আগে একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের দুই 'রুটির ঝুড়ি' রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলেও একই পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব।
২০২০–২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট গম আমদানির ৩৮ শতাংশ এ দুই দেশ থেকে আমদানি করেছে। ২৪ শতাংশ গম আমদানি করা হয়েছিল ভারত থেকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যুদ্ধের পর যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা এখন নেই; আমদানি স্বাভাবিক হয়েছে। 'আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে দাম পরিশোধের কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই গম আমদানি করতে পারছি।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইসরায়েল ও গাজা যুদ্ধ শুরুর পর লোহিত সাগরে যে সংকট দেখা গিয়েছিল, সেটিও এখন কমেছে। এ সাগরে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
বাংলাদেশি ভোক্তারা ক্রমশ তাদের খাদ্যতালিকায় গম অন্তর্ভুক্ত করছেন। বর্তমানে দেশের বার্ষিক গমের চাহিদা ৭০–৭৫ লাখ মেট্রিক টন। এর প্রায় ৮৫–৯০ শতাংশ পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে।
যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া ও ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত প্রভাবের ফলে বিশ্বব্যাপী গম সরবরাহ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাসের মাঝে দেশের গম আমদানি ২০২১–২২ অর্থবছরে ৪০ লাখ মেট্রিক টনে নেমে এসেছিল।
বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, যুদ্ধের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সারাবিশ্বের মতো স্থানীয় বাজারে গম এবং গমজাত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তবে গত কয়েক মাসে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।
বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড-এর বিক্রয় ও বিতরণ প্রধান রেদোয়ানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ও সরবরাহ এখন স্বাভাবিক। আমাদের বেশিরভাগ গম আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যদিও সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামও যুদ্ধের আগের অবস্থায় নেমে এসেছে। তবে স্থানীয় বাজারে যেটুকু বাড়তি দাম রয়েছে, তা ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে হচ্ছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক পণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকেই গম আমদানি করা হলেও বেশিরভাগই আসছে রাশিয়া থেকে।
এ গম আমদানিকারক বলেন, 'বিশেষ করে ক্রলিং পেগ প্রবর্তনের পর থেকে তুলনামূলক স্থিতিশীল বিনিময় হার এবং গমের দাম কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা শস্যটি আমদানি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন।'
বেসরকারি খাতের আমদানিকারকদের মধ্যে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, শেখ ব্রাদার্স ও সৈনিক গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেশিরভাগ গম আমদানি করে থাকে।
এর মধ্যে মেঘনা, সিটি ও বসুন্ধরা গম আমদানি করে প্যাকেটজাত আটা হিসেবে বিক্রি করে। এ আমদানিকারকেরা কেবল রাশিয়া থেকে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন গম কিনেছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, তারা রাশিয়া থেকে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই গম আমদানি করছেন। 'পাশাপাশি ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল থেকেও শস্যটি আমদানি করা হচ্ছে,' জানান তিনি।
বেসরকারি আমদানিকারকদের মতে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন গম রপ্তানি করতে আগ্রহী, কারণ দেশগুলোর গমের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। তারা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কাজাখস্তান, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং অন্যান্য দেশের মাধ্যমে রপ্তানি হওয়া বেশিরভাগ গম এ দুটি দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে।
বিশেষ করে ইউক্রেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে মজুত গম দ্রুত ছাড়ের উদ্দেশ্যে দরকষাকষি ছাড়াই গম রপ্তানি করছে।
বাজারে গমের দাম এখনও বেশি কেন?
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আটার দাম এমনকি চালের দামকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এতে বেকায়দায় পড়েন সাধারণ ভোক্তারা। এখন অবশ্য বিশ্ববাজারে গমের দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এলেও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এখনো সে পর্যায়ে নামেনি।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) অনুসারে, ২০২২ সালের মার্চে প্রতি কেজি খোলা আটা ৩৫–২৬ টাকা ও প্যাকেট আটা ৪০–৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। যুদ্ধের প্রভাবে খোলা আটা ৫৫ টাকা এবং প্যাকেট আটা ৬৫–৭০ টাকায় উঠে যায়।
তবে বাজারে দাম এখন খানিকটা কমে খোলা আটা ৪০–৪৫ টাকা ও প্যাকেট আটা ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ দাম ২০ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও ১৬ শতাংশ কম।
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ)-এর ২৫ জুনের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন রাশিয়া, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের গম বিক্রি হচ্ছে প্রতি মেট্রিক টন ২২৭–২৪০ ডলারে, যা যুদ্ধ শুরুর পর সাড়ে তিনশ থেকে ৪০০ ডলারে উঠেছিল।
ভারতের ওপর নির্ভরতা কমছে
২০২১–২২ অর্থবছরে দেশে ভারত থেকে ৬২ দমমিক ৩ শতাংশ, কানাডা থেকে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ইউক্রেন থেকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অষ্ট্রেলিয়া থেকে ৭.৬ শতাংশ, আর্জেন্টিনা থেকে ৪.৭ শতাংশ এবং রাশিয়া থেকে ২.১ শতাংশ গম আমদানি করা হয়।
তবে নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত ২০২২ সালের ১৩ মে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দেশটি এখনো রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার মাঝে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ আরও বেশি চাপে পড়ে।
এ পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বই যখন এক ধরনের খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে শুরু করে, তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ শুরুর পাঁচ মাসের মাথায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি হয়।
এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন দুই দেশই শস্যদানা রপ্তানিতে কেউ কারও জন্য বাধা হবে না বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রাথমিকভাবে ১২০ দিনের এ চুক্তি পরবর্তীকালে নবায়ন করা হয় এবং শস্যদানা রপ্তানি সংকট ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
তবে এ পরিস্থিতিতেও ২০২২–২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি জটিল হয়ে পড়ে। ফলে আমদানি নেমে আসে মাত্র ৩৮.৭৫ লাখ মেট্রিক টনে।
সরকারি-বেসরকারি আমদানিকারকেরা বলছেন, এখন রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি হচ্ছে নিয়মিত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার আমদানির অর্থ পরিশোধে কিছু জটিলতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের মধ্যস্থতায় এসব অর্থ ডলারের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হচ্ছে।
গমের দামে স্থিতিশীলতা প্রত্যাশিত
ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-এর এ বছরের মার্চের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া এবং রাশিয়ায় গমের উৎপাদন বাড়বে। এর ফলে এ খাদ্যটির আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটসভুক্ত দেশগুলোর নিপ্রোভিত্তিক একটি কৃষি-ব্যবসা পরামর্শক সংস্থা এপিকে-ইনফর্ম অ্যানালিটিক অ্যান্ড ইনফরমেশন এজেন্সি অনুসারে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গম রপ্তানি ৩৫.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা গত মৌসুমের একই সময়ের তুলনায় ৩.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি।
সংস্থাটি অনুমান করেছে, চলতি মৌসুমের পুরো সময়জুড়ে রাশিয়া থেকে গম রপ্তানির মোট পরিমাণ হবে ৫২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন।