'চালাইদেন': ভুল তথ্যে ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৮টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শেষ হয়ে আসার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) সদস্যদের প্রোফাইল থেকে ফেসবুক-এর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু পোস্ট আসতে থাকে। এমনকি কয়েকজন আন্দোলনকারীর প্রোফাইল থেকেও একইরকম পোস্ট দেওয়া হয়।
সারাদেশে চলমান বিক্ষোভের আয়োজনকারী প্ল্যাটফর্ম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সেদিন শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করার পরে পোস্টগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে শুরু করে।
ছাত্রলীগ সদস্যদের কিছু পোস্টে দাবি করা হয়, আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী হাসনাথ আবদুল্লাহ এবং সারজিস আলম আন্দোলনকে বাড়ানোর জন্য ঘুষ হিসেবে ৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। অন্যদের অভিযোগ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) একজন সমন্বয়কের বাড়ি থেকে নগদ টাকার বান্ডিলের ছবিসহ ২ কোটি টাকা জব্দ করেছে; নগদ টাকার বান্ডিলের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়। আরেকটি গুজব ছড়ানো হয় যাতে বলা হয়, সমন্বয়কারীরা রাজধানী ঢাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন।
এই পোস্টগুলো ভাইরাল হওয়ার আগে দুটো ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো শুরু হয়। এর মধ্যে একটি হলো, 'আগামীকাল ঢাকা ৭ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার করা হবে।' এই পোস্টের সঙ্গে ছাত্রলীগের সদস্যদের মিছিল বা সমাবেশের পুরনো ছবি ও ভিডিও যুক্ত করা হয়।
পোস্টের মন্তব্য বিভাগে (কমেন্ট সেকশন) ফেসবুক ব্যবহারকারীরা শেয়ার করা ছবিগুলোর প্রকৃত উত্স সনাক্ত করতে শুরু করে৷
অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের পোস্টে দাবি করা হয়, ছাত্রলীগ নেতারা রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বা আওয়ামী লীগ তাদের ৪ আগস্টের কর্মসূচি বাতিল করছে। এমনকি একটি পোস্টে তারা ছাত্রলীগের লোগো ও একজন ছাত্রলীগ নেতার স্বাক্ষর ব্যবহার করেছেন।
এএফপির ঢাকা ব্যুরোর ফ্যাক্ট চেক এডিটর কাদেরউদ্দিন শিশির বলেছেন, "গত দুদিনে আমরা ভুল তথ্য বা ভুয়া পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য জন্য মানুষের কাছ থেকে অগণিত অনুরোধ পেয়েছি। পরিস্থিতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে আমরা এখন অনলাইনে পাওয়া প্রতিটি তথ্য ট্র্যাক করতে এবং ডিবাঙ্ক করতে অক্ষম৷ এগুলোর মধ্যে কিছু পোস্ট ডিবাঙ্ক করার জন্য আমরা কাজ করছি কারণ এগুলো সড়িয়ে ফেলা জরুরী।"
শিশির এএফপি ফ্যাক্ট চেক-এর বাংলা ভাষার সাইটের সমন্বয় করেন।
শিশিরের মতে, এসব পোস্টের মাধ্যমে সমন্বিত অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে এবং ৩ আগস্ট তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
শিশির বলেন, "তারা দুটো প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরনের ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ভুয়া স্ক্রিনশট তৈরি করছেন; প্রতিবাদকে দমন করা এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের উৎসাহিত করা।"
মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট ব্যবহার
আন্দোলনকারীরা একটি পাল্টা 'চালাইদেন' প্রচারণার মাধ্যমে এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাকে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলায় 'চালাই দেন' শব্দ দিয়ে মূলত 'এটি অনলাইনে চালান' বা 'এটি ছড়িয়ে দিন' বোঝানো হয়েছে।
সাধারণত ছাত্রলীগ নেতারা ব্যক্তিগত চ্যাট গ্রুপে একটি পোস্ট লেখেন এবং সেই গ্রুপের প্রত্যেকেই তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযগমাধ্যম প্রোফাইলে পোস্টটি কপি করে ছড়িয়ে দেন। এমনই একটি পোস্টে কেউ 'চালয়দেন' নির্দেশনাটি মুছতে ভুলে যায় এবং সেভাবেই শব্দগুলো অনলাইনে পোস্ট করেন।
এরপর থেকে এই ধরনের গুজবকে 'চালাইদেন' প্রচারণার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন তারা যাই পোস্ট কদিচ্ছেন না কেন, শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীরা "চালাইদেন" কমেন্ট (মন্তব্য) করছেন।
আন্দোলনকারীরা ইমরান হাশমি, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সানি লিওনের মতো তারকাদের ছবি সমন্বিত ফটো কার্ড দিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব ফটোকার্ডে তারকাদের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যদের ছরানো গুজবগুলোকে উধ্বৃতি হিসেবে দিতে দেখা যাচ্ছে।
কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে আছেন। গত রাতে ছাত্রলীগের নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিএসসি দখল করে নিয়ে গভীর রাতে সেখানে জড়ো হয়েছেন দাবি করে একটি ভিডিও প্রচার করেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় সাতজন যুবক সেখানে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করেছিলেন এবং ভিডিও তৈরি করেছিলেন যাতে দেখা যায়, সেখানে কেবল কয়েকটি কুকুর ঘোরাফেরা করছে। হাস্যকরভাবে, কিছু সাংবাদিক ছাত্রলীগের বিক্ষোভ কভার করতে শুধু একটি ফাঁকা ক্যাম্পাস দেখতে পান।
কাদেরউদ্দিন শিশির মনে করেন, এই ধরনের একটি ক্রমবর্ধমান সংকটে লোকেরা অনলাইনে আরও বেশি ভুল তথ্য শেয়ার করার প্রবণতা রাখে। এর দুটি কারণ রয়েছে—সংকটের সময় বহু তথ্যের ছড়াছড়ি এবং মূলধারার মাধ্যম থেকে তথ্য প্রবাহে আস্থার অভাব।
তিনি বলেন, "এই ধরনের পরিস্থিতিতে মূলধারার মাধ্যমগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করা হয়। তাই যখন লোকেরা এমন কোনও তথ্য পায় যা নিয়মিত মিডিয়াতে পাওয়া যায় না, তখন তারা এটি একটি বিশ্বস্ত উত্স থেকে এসেছে কি না তা যাচাই না করেই শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করে। যখন এরকম একাধিক তথ্য প্রচারিত হয় তখন প্রতিটি তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়।"