ডাকাত আতঙ্ক: বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীদের নিরাপত্তা কমিটি
বর্তমান পরিস্থিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট ও ডাকাতির মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে কিছু সংখ্যক জায়গায় লুটপাঠ ও ডাকাতির খবর শুনে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। তাই কোনো কোনো এলাকাতে ডাকাতি না হওয়া সত্বেও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে আছে মানুষ। তবে এ আতঙ্ক থেকে রেহাই পেতে স্ব-উদ্যোগেই গড়ে উঠছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কেউ এলাকাবাসীদের নিয়েই গড়ে তুলেছে বাহিনী, আবার কোনো কোনো জায়গায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন গ্রুপ থেকেই গড়ে উঠছে স্বেচ্ছাসেবক দল। তারাই লাঠি-বাঁশি হাতে রাতভর পাহারা দিচ্ছেন। দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডাকাত আতঙ্ক, পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো থানায় পুলিশ নেই। গত ৫ আগস্ট জেলার সবকটি থানায় তাণ্ডব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সদর মডেল থানায়। এর ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে গা ঢাকা দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এ অবস্থায় পুলিশের অনুপস্থিতিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধ সংগঠিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম জানান, পারিবারিক একটি সমস্যায় পড়ে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা উত্তোলন করে বাসায় এনে রেখেছেন। কিন্তু চলমান উদ্ভুত পরিস্থিতে পুলিশ না থাকায় ঘরে ডাকাত আতঙ্কে সময় পার করছেন তিনি।
আশিকুর রহমান নামে আরেক বাসিন্দা জানান, সন্ধ্যার পর থেকে মানুষ আতঙ্কে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এজন্য সন্ধ্যার পর থেকেই মহল্লার লোকজন পালাক্রমে ভোর পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। গত ৬ আগস্ট থেকে এভাবেই মহল্লায় নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, চুরি-ডাকাতি রোধে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। শীঘ্রই পাড়া-মহল্লাগুলোতে কমিটি গঠন করবে তারা। এছাড়া শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী, স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট ও বিএনসিসি।
রাজশাহীতে পাহারায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দল
রাজশাহীতে ডাকাত প্রতিরোধে বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে সারারাত পাহারা দিতে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় মহল্লার বাসিন্দারাও ডাকাত আতঙ্কে রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন। কয়েক জায়গায় ডাকাতির চেষ্টার খবর পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ গুজব বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল রাতে শহরের কোর্ট চত্বর, হড়গ্রাম বাজার , পবার উপজেলার নওহাটা ও গোদাগাড়ী বাজারে ডাকাতির চেষ্টার খবর পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয় জনতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা তা প্রতিহত করেছেন। কয়েকজন সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করার খবরও পাওয়া গেছে। তবে গুজবও ছড়িয়েছে বেশি বলে মনে করছেন তারা। স্থানীয়রা, স্বেচ্ছাসেবকরা মিলে নগরীর আলুপট্টি মোড় থেকে সন্দেহভাজন একজনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। তার কাছে দুইটি এন্টি-কাটার পাওয়া গেছে।
'সেইভ রাজশাহী' নামের একটি ফেসবুক ও হোয়াটস্যাাপ গ্রুপ থেকে ১০০ জনের ছয়টি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ নগরীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম, আলুপট্টি ব্যাংকপাড়া, কোর্টের মোড়, সিঅ্যান্ডবি, নগর ভবন ও সাগরপাড়া বটতলা মোড়ে সারারাত পাহারা দিয়েছেন। এছাড়া দুইটি বাইকার টিম গঠন করা হয়েছিলো যারা তাৎক্ষণিকভাবে শহর বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গেছেন।
খুলনায় নিরাপত্তা দল গঠন
খুলনা শহর জুড়ে এখন ডাকাতির আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে মানুষের। মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যেকে পাড়া, গলি ও গুরুত্বপূর্ন স্থানে স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা দল তৈরী করেছেন। বুধবার দিবাগত রাতে খুলনা শহরের ইকবাল নগর ঘুরে দেখা যায় অন্তত ১০ টি নিরাপত্তা দল রয়েছে। প্রত্যের দলে ৫ থেকে ২০ জন সদস্য রয়েছে। এছাড়া তারা হাতে লাঠি ও বাশি নিয়ে ঘুরছেন।
নিরাপত্তা দলের সদস্য লুতফুল নামের এক ব্যক্তি বলেন, "আমার বাড়ি এই এলাকায়। প্রত্যেক বাড়ি থেকে একজন করে নিয়ে আমরা নিরাপত্তা দল গঠন করেছি। রাতভর পাহারা দিব।"
তবে ওই এলাকায় গত এক সপ্তাহের মধ্যে কোথাও ডাকাতি হয়নি বলে জানান তারা। তবে অগ্রীম সতর্কতা হিসেবে তারা নিরাপত্তা দল টহল দিচ্ছে। শুধু আবাসিক এলাকায় নয়, বাণ্যজিক এলাকায় এর থেকে বেশি নিরাপত্তা দল গঠন করা হয়েছে। খুলনার ডাক বাংলা, পিকচার প্যালেস, বড় বাজার ও নিউমার্কেট ঘুরে নিরাপত্তা দলের উপস্থিতি দেখা গেছে। বড় বাজারের ব্যবসায়ী আসাদ খান বলেন, প্রত্যেকেটি দোকানে কম করে হলেও ৫০ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় শহরের অনেক দোকানে শার্টার ভেঙ্গে লুট করা হয়েছে। তাই আমরা ওই দিন থেকে নিরাপত্তা দল গঠন করে ফেলেছি।
নওগাঁয় ডাকাত ঠেকাতে জনগণের বাহিনী গঠন
নওগাঁ সদরের চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী এলাকায় গত আগস্ট পুকুর থেকে মাছ লুট করেছেন দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকে বাড়িঘরে তাণ্ডব কিংবা ডাকাতি ঠেকাতে পাড়া মহল্লায় নিজেরা বাহিনী গঠন করেছেন। সাধারণ জনগণের এই বাহিনী পালাক্রমে তাদের জানমাল ও সম্পদ রক্ষায় কাজ করছেন।
নওগাঁর শহরের লাটাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আরমান হোসেন বলেন, জেলায় এখন কার্যত পুলিশিং কার্যক্রম নেই। এই সুযোগ এক শ্রেণির মানুষ ডাকাতি, লুটপাটসহ বহুমুখী তাণ্ডব চালাচ্ছেন। এই কারণে মানুষ এখন বাধ্য হয়ে শহরের মধ্যেও প্রতিটি এলাকা ধরে রাতের বেলায় পাহাড়া বসিয়েছেন। তবে শহরে ভালো ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু গ্রামের দিকে এখনো ঘটনা ঘটছে। প্রায় সব জেলায় একই চিত্র।
নিরাপত্তার অভাবে বগুড়ার শহরের ইয়ামাহ মোটরসাইকেলের ডিলার আব্দুল মোত্তালেব মানিক তার প্রতিষ্ঠান কয়েকদিন ধরে বন্ধ রেখেছেন। হাসিনা পদত্যাগ করার পর শহরে ভাঙচুর ও তাণ্ডব শুরু হয়। এরপর থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য তিনি আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। মানিক জানান, এভাবে কতোদিন চলা যায়। সাধারণ মানুষের জন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর কার্যক্রম শুরু হওয়া খুবই জরুরি।
উত্তরের অন্যান্য জেলার মতো গাইবান্ধাও সাধারণ শ্রেণি পেশার মানুষ নিজেরা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছেন। জেলার রোমেল নামের এক সংবাদকর্মী বলেন, শহরের এখন সমস্যা কম। কিন্তু গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পয়সাওয়ালা লোকজনের কাছে চাঁদাবাজি করছে একটা গ্রুপ। চাঁদা না দিলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারীদের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
বরিশালে হামলা-লুটতরাজ ঠেকাতে ছাত্র-জনতার টহল
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি ও টার্গেট হামলা ঠেকাতে বরিশালে কাজ করছে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো। দিনে-রাতে উভয় সময়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিরাপত্তা দিচ্ছে। এতে করে আতঙ্ক কিছুটা কমে এসেছে। বরিশাল শহর ও আশপাশের এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ছাত্র জনতার সাথে নতুন করে সুসর্ম্পক স্থাপনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করেছে মাঠ প্রশাসন। সহাবস্থান নিশ্চিতে কয়েকটি জেলায় ইতোমধ্যে স্থানীয় বিশিষ্টজন, রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্র প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রশাসন।