অতি-আত্মবিশ্বাস: যেভাবে হাসিনা সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন-অযোগ্য করেছিলেন
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। সে সময় আপিল বিভাগ একটি রায়ে সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কিত বিষয় ব্যাখ্যা করা হয় এবং সেখানে এটিও বলা হয় সংসদ পরবর্তী সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে এরকম কোনো আইনও প্রযোজ্য নয়।
এ বিষয়ে আপিল বিভাগ শাহরিয়ার রশিদ খান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে বলা হয়, "একটি মন্ত্রিসভা কোনো আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার পরবর্তী মন্ত্রিসভাকে বাধ্য করতে পারে না এবং তাই সংসদ কোনো অসংশোধনযোগ্য বা বাতিল অযোগ্য আইন পাস করতে পারে না।" সেসময় এ রায়টি বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস (বিএলডি) পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল।
কিন্তু ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বেমালুম ভুলে যান সেসব কথা এবং সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন।
সংবিধানকে সংশোধনের অযোগ্য করা
উপরের কথাটি অবাস্তব শোনালেও, ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আনে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৫০টিরও বেশি অনুচ্ছেদ অসংশোধনীয় বলে বিধান করা হয়। যার অর্থ হলো ভবিষ্যৎ সংসদ সেসব সংবিধান প্রয়োজনেও সংশোধন করতে পারবেনা। এ বিধান জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলোর প্রতি একটি নির্মম অসংবেদনশীলতার পরিচয়।
এভাবে শেখ হাসিনার দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সংসদের ক্ষমতা অবরুদ্ধ ও সীমিত করে দেয়। এমন সিদ্ধান্ত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নজিরবিহীন।
এ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। যার ফলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হুমকির মুখে পড়ে এবং এ সংশোধনী নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি আঘাত
সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর অধিকাংশই দেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতি ও বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত। আর এ অনুচ্ছেদগুলোই সংশোধনীর মাধ্যমে অসংশোধনযোগ্য ও অবাতিলযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এসব অনুচ্ছেদ অসংশো্ধনযোগ্য ও অবাতিলযোগ্য করার মানে হলো জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর কোনোই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ মৌলিক অধিকার অধ্যায়েরে সব অনুচ্ছেদই অসংশো্ধনযোগ্য ও অবাতিলযোগ্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- শিক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার নয়। যদি কোনো ভবিষ্যৎ সরকার একে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ১৫ তম সংশোধনীর কারণে তা আর কোনো ভাবেই সংশোধন করা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, ভারতীয় পার্লামেন্ট ২০০২ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে শিক্ষাকে ভারতের নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদটি বলে যে, রাজ্য ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী সকল শিশুকে বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদান করবে, যা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে।
ঠিক তেমনিভাবে, যদি কোনো ভবিষ্যৎ সংসদ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কোনো আইনের মাধ্যমে আরোপিত সীমাবদ্ধতা তুলে নিতে চায়, তবে তা করার জন্য সংবিধানের ৩৭ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। কিন্তু ৩৭ নং অনুচ্ছেদও অসংশোধনযোগ্য করা হয়েছে।
সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আইনে সংবিধানের প্রথম অংশে নতুন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।
অনুচ্ছেদ ৪(ক) অনুযায়ী, "জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে এবং সকল সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোর প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।"
এই বিধানকেও কোনো সংসদ দ্বারা সংশোধন করা যাবে না, কারণ এটি সংবিধানের প্রথম অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং পুরো অংশটি অসংশোধনযোগ্য করা হয়েছে।
সংবিধানের পরিপন্থি নয় এমন আইন বাতিল, পরিবর্তন বা সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের থাকা উচিত। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীও সংবিধানের ২৪২তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংসদীয় ক্ষমতার মাধ্যমে প্রণীত একটি আইনেরই অংশ।
সংবিধানের কিছু অংশ সুরক্ষিত
সংবিধানকে একটি জীবন্ত দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিকশিত হয়। কিন্তু হাসিনা সরকার সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে কার্যত মেরে ফেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তার বই "কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ"-এ লিখেছেন সংবিধান একটি জীবন্ত দলিল; এটি সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়।
তিনি আরো লিখেছেন, "সংবিধানকে স্থায়ী বলে মনে করা হয়। কিন্তু যেহেতু সব পরিবর্তিত পরিস্থিতির পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতের উন্নয়নের সাথে মানিয়ে নিতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে, সেসব পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে পরিবর্তনগুলি কার্যকর করার জন্য সংবিধানেই একটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।"
তার বইটিতে আরো লেখা হয়েছে, "যখন সংবিধানের একটি সৃষ্টি হিসেবে সংসদকে সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখন এটি সংবিধানকে ধ্বংস করার জন্য নয় বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একে উপযুক্ত করার জন্য এ ক্ষমতা দেওয়া হয়।"
কিন্তু সংশোধনীটি ভবিষ্যতের উন্নয়নের সাথে মানিয়ে নিতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার জন্য, রাষ্ট্রনীতির মৌলিক নীতি এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোতে পরিবর্তন আনার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
তাই এই বিতর্কিত সংশোধনীটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় যে শেখ হাসিনার অধীনে থাকা ৯ম জাতীয় সংসদ কি সংশোধনীর নামে সংবিধান ধ্বংস করতে চেয়েছিল?