২০২০: জ্বালানি তেলের বাজার দখলের তীব্র যুদ্ধের বছর
''বিশ্বাস করুন, আজকের দিনটি নিয়ে সবাই আফসোস করবে'' ঠিক একথাই বলেছিলেন সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী আব্দুল আজিজ বিন সালমান। গত ৬ মার্চ ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওপেক প্লাস জোটের বৈঠকে একথা বলেন তিনি।
করোনাভাইরাস যখন বৈশ্বিক উৎপাদন ও পরিবহন খাতে ঘোর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা সবে শুরু করেছিল, তখন কমছিল জ্বালানি তেলের দর। এরমধ্যে ওপেকের বারংবার আহ্বান সত্ত্বেও জ্বালানি বাজারে সরবরাহ কমায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলশ্রুতি ভিয়েনায় ওপেক প্লাসের বৈঠক, এবং তাদের একতরফা সরবরাহ কর্তনের সিদ্ধান্ত।
ওপেক প্লাস হচ্ছে; জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশগুলোর জোট ওপেকের সদস্য নয়, এমন উৎপাদকদের সঙ্গে সাময়িক জোটবন্ধন। এর অন্যতম বৃহৎ অংশীদার রাশিয়া। প্লাসের অন্য সদস্যরা হচ্ছে; রাশিয়ার প্রভাবাধীন মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ, যারা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এছাড়া, আছে আফ্রিকার কিছু জ্বালানি উৎপাদকও।
৬ মার্চকে জ্বালানি তেল বাজারের জন্য অশুভ দিন বলেছিলেন সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী। তার ওই অনুমান বৃথা হয়নি। এরপর থেকে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং রাশিয়ার মতো শীর্ষ জীবাশ্ম তেল উত্তোলনকারী দেশের মধ্যে এক গোপন রক্তাক্ত যুদ্ধের সূচনা করে।
মহামারির মধ্যে এ সংঘাতে প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে পণ্যটির দর। দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ভীতি সৃষ্টি হয় ওপেকের আহ্বানে সাড়া না দেওয়া মার্কিন জ্বালানি উৎপাদকদের মাঝেও। এ অবস্থায় হুমকির মধ্যে পড়তে পারে দীর্ঘ কয়েক দশক পর অর্জিত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ জ্বালানি স্বনির্ভরতা। প্রশ্ন উঠছে তেল ও গ্যাস খাত কী এই বাজারপতনের ধাক্কা সামলাতে পারবে?
এজন্য আরেকটু পেছনের দিকে তাকানো দরকার। ২০১৭ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দর নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না ওপেক। ওই বছরেই ভিয়েনায় ওপেকের সদর দপ্তরে রাশিয়া ও তার মিত্রদের সঙ্গে প্লাস জোট করে জ্বালানি সরবরাহ কর্তনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন থেকেই সীমিত আকারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছিল ওপেক প্লাস।
চলতি বছরের মার্চের বৈঠকে এপ্রিল থেকেই বিশ্ববাজারে দৈনিক সরবরাহ ১৫ লাখ ব্যারেল কমানোর বিষয়ে ঐক্যমত্য হয় ওপেক প্লাস বৈঠকে। এরমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়; ওপেকের মূল সদস্যরা কমাবে ১০ লাখ ব্যারেল এবং রাশিয়ার মতো ওপেক বহির্ভূত দেশ কমাবে বাকি ৫ লাখ ব্যারেল।
আগেই বলা হয়েছে, মার্চের ওই বৈঠকের আগেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন হচ্ছিল। যার মূল কারণ ছিল; চীনের মতো শীর্ষ আমদানিকারক দেশের লকডাউন এবং মার্কিন উৎপাদকদের বিপুল সরবরাহ।
বৈঠকের আগে ইরানি তেলমন্ত্রী বিজান জাঙ্গানেহ সতর্ক করে বলেন, রাশিয়ার মতো ওপেক বহির্ভূত দেশগুলো সরবরাহ হ্রাসের এ সমঝোতা মেনে না নিলে, ওপেক নিরুপায় হয়ে পড়বে। তিনি ঠিকই বলেছিলেন।
রাশিয়া এ সমঝোতা মানতে পরবর্তীতে অস্বীকার করে। ওই সময়ে নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সরবরাহ কমালে সেই সুযোগে জ্বালানি রপ্তানির বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে- এমন কারণ দেখায় দেশটি।
রাশিয়ার যুক্তিতে ক্ষুদ্ধ হয় সৌদি আরব। তাছাড়া, তেলের বাজারদর নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকেও কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল সৌদি আরবকে। ৩০ এপ্রিল বার্তা সংস্থা রয়টার্স সূত্রে জানা যায়, ট্রাম্প সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, বাজার সরবরাহ না কমালে দেশটিকে দেওয়া সামরিক সুরক্ষার চুক্তি প্রত্যাহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। ঘনিষ্ঠ মিত্রের এ হুমকি সৌদিকে আরও ক্ষুদ্ধ করে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাজার দখলের যুদ্ধ শুরুর।
কমানোর বদলে তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ায় সৌদি আরব। বিশ্ব বাজারে সয়লাব হয় বাড়তি তেলের মজুদে। এপ্রিল নাগাদ উৎপাদন ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দৈনিক এক কোটি ২৩ লাখ ব্যারেল উত্তোলন বৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া হয়।
এভাবেই ভারত, চীনসহ এশিয়ার শীর্ষ জ্বালানি ভোক্তা বাজারে হারিয়ে যাওয়া অংশীদারিত্ব পুনরুদ্ধারের প্রয়াস চালায় সৌদি। দরপতন কন্টিনেন্টাল শেল বা মহাদেশীয় ভূস্তর থেকে মার্কিন তেল উৎপাদক কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়ে আঘাত হানবে, এটাও সৌদি ভালো করেই জানত।
তারপরও তেল রপ্তানি নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রটি এপ্রিলে তেলের বিক্রয়মূল্য আরও কমায়। ফলে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র-সহ ওপেক বহির্ভূত বড় উৎপাদকেরা কঠিন চাপে পড়ে। কিছু প্রতিবেশী দেশও সৌদি আরবকে অনুসরণ করে, যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এ অবস্থায় রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল; তারা পহেলা এপ্রিলে ওপেক প্লাস চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্র উৎপাদন দৈনিক ৫ লাখ ব্যারেল বৃদ্ধি করবে। ফলে তাদের মোট উৎপাদন দাঁড়াবে দৈনিক এক কোটি ১৮ লাখ ব্যারেলে।
এসব ঘোষণায় বাজার প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষনিক। চাহিদা সংকটে ইতোমধ্যেই দুর্বল তেলের দর আরও অর্ধেক হ্রাস পেয়ে দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারে নেমে আসে গত ১৮ মার্চেই। টানা পাঁচ বছর ৫০ ডলারের উপর এবং এক দশক ধরে ১০০ ডলারের কাছাকাছি বিক্রয় হওয়ার পর খাড়া এ পতন হয়।
বহুজাতিক মার্কিন ব্যাংক মরগ্যান স্ট্যানলি'র অনুমান চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক নাগাদ ব্রেন্ট বা লাইট ক্রুড ৩০ ডলার ব্যারেলে বিক্রি হবে। অন্যদের শঙ্কা, সৌদি ও রাশিয়া দ্বৈরথ না থামলে- দর আরও কমে ১০ ডলার ব্যারেল পর্যন্ত নামতে পারে। যদিও সে আশঙ্কা এখনও বাস্তবে রূপ নেয়নি। কিন্তু সে হুমকি রয়েই গেছে।
কালো স্বর্ণ নামের পরিচিত জ্বালানি তেল এখন; কোভিড-১৯ মহামারি, বিপুল পরিমাণ বিদ্যমান মজুদ এবং সরবরাহকারীদের প্রতিযোগিতার ত্রিমুখী সঙ্কটে পর্যদুস্ত । মহামারি বিশ্ব অর্থনীতির নানা খাতে যে মন্দা তৈরি করেছে, তাতে সচল হওয়ার পরও নানাখাতের জ্বালানি চাহিদা আগের চাইতে ১০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই বাড়তি সরবরাহের পরিমাণ ৮০ কোটি থেকে ১৩০ কোটি ব্যারেল ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল- আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষক আইএইচএস মার্কিট।
লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জীবাশ্ম তেল বাজারের প্রধান জিম বুর্খহার্ড জানান, 'বিশ্ব বাজারে জ্বালানির এ পরিমাণ অতিরিক্ত সরবরাহ এর আগে কখনো দেখা যায়নি।'
''এর আগে চলতি শতকে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত সরবরাহের রেকর্ড ছিল ৩৬ কোটি ব্যারেল। কিন্তু, এখন যে পরিমাণ মজুদ, তার চাইতেও দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ চালান প্রবেশের অপেক্ষায় আছে'' তিনি যোগ করেন।
মার্কিন উৎপাদকরা মূলত হেভি ক্রুড বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ভারি ধরনটি উৎপাদন করে। এর মূল সূচক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট গত ২৪ মার্চেই পতন লক্ষ্য করেছিল। ওই সময় হেভি ক্রুড লেনদেন হয় ২৪ ডলার ব্যারেলে। ব্রেন্ট বা লাইট ক্রুডের ফিউচার্স সূচকে দর নামে ২৭ ডলারে। সে সময় অর্থনৈতিক করুণ অবস্থায় মার্কিন সরকার ২ লাখ কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পরিকল্পনা করছিল। দেখা যাচ্ছে, সে প্রেক্ষাপটও তেলের স্থানীয় বাজারকে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চিত নন, জ্বালানি বাজার কীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে! তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বৃহৎ উৎপাদকদের মধ্যে মন্দাকালীন বাজারে সমন্বয়ের অভাব, দিনশেষে তাদের সকলের জন্যেই সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তেলের বাজার চলতি সেপ্টেম্বরে ৪০ ডলার ব্যারেলের ঘরে ফিরলেও, মহামারি এখনও পৃথিবীর ঘাড়ের কাছে ঘাতকের নিঃশ্বাস ফেলছে। যেকোনো মুহূর্তেই বছরের প্রথমভাগের স্থবিরতার চিত্র আবার ফিরে আসলে, তখন জ্বালানি তেলের দর কতদূর পতন হবে-তা নিয়েই রয়েছে মূল শঙ্কা।
- লেখক: অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন ভিত্তিক একজন লেখক, যিনি দীর্ঘ কয়েক দশক এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
- অনুবাদ: নূর মাজিদ