মহামারির অভিঘাতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসায় ১৫০০ কোটি টাকার লোকসান
করোনার অভিঘাতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে ২০ হাজার কোটি টাকার জাপানি রিকনিডশন্ড (একবার ব্যবহৃত) গাড়ির ব্যবসা।
মহামারির সময় ব্যবসার সাথে জড়িতদের আমদানি ও বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। করোনায় গত ১৪ মাসে সব মিলিয়ে এ খাতে লোকসান হয়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বিশাল এই খাতের কোনো পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই কারোনাকালীন সরকারি আর্থিক প্রণোদনা পাননি। শোরুম ও অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, অতিরিক্ত শুল্ক কিছুটা কমানোর পাশাপাশি নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি শুল্ক সমান রাখা হোক। পাশাপাশি, লকডাউনে তিন মাস বন্দরে আটকে থাকা অবস্থায় মাসুল বাবদ অর্থ ফিরিয়ে দেয়া হোক।
একইসঙ্গে, ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরো পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা করা না হলে এ খাতের লোকসান কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।
জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড টয়োটা গাড়ি আমদানি করেন মতিউর রহমান। রাজধানীর ঢাকাতে ও গাজীপুরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শো রুম রয়েছে তার। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, করোনা আসার পর থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি ও বিপণন অনেক কমে গেছে।
"করোনার আগে মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ টি প্রাইভেট গাড়ি বিক্রি করতাম। প্রায় ছয় থেকে সাত কোটি টাকার গাড়ি বিক্রি হতো মাসে। আর এখন মাসে আট থেকে ১০টি গাড়ি বিক্রি হয়। অর্থাৎ, প্রতি মাসে দুই-এক কোটি টাকার গাড়িও বিক্রি হয় না," বলেন তিনি।
মতিউর রহমান আরও বলেন, "আমাদের কাস্টমার মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু, তাদের হাতে টাকা নেই। তাছাড়া, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিলাসজাত পণ্য। পাশাপাশি করোনার কারণে আন্তজাতিক বাজারেও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।"
"লকডাউনে বন্দরের তিন মাসের ভাড়া ও অতিরিক্ত শুল্ক ইত্যাদির কারণে পুরাতন গাড়ির দাম অনেক বেড়ে গেছে- সব মিলিয়ে পুরাতন গাড়ি ক্রয়ের প্রতি মানুষের আর আগের মতো আগ্রহ নেই, তাই আমাদের কাস্টমার অনেক কম। দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং ব্যাংক লোন পরিশোধের কোন উপায় না দেখে অনেক ব্যবসায়ী এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন," বলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যবসায়ী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে আমি জাপান থেকে টয়োটা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে আসছি। কিন্তু, বিগত কয়েক বছর থেকে আমার ব্যবসায় বেশ মন্দা যাচ্ছে। সর্বশেষ করোনা মহামারিতে চূড়ান্ত ধস নেমে আসে, লকডাউনে গত বছর তিন মাস এবং এ বছর এক মাস ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।"
"লকডাউনে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি ও বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এছাড়া, পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় আমাদের ক্রেতা ছিল অনেক কম। আমার বিক্রি হয়নি বললেই চলে," বলেন তিনি।
তিনি আরো জানান, "এই করোনায় সব মিলিয়ে আমার এক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, শোরুম ও অফিস ভাড়া, কর্মচারিদের বেতন ও ক্ষতি পোষাতে না পেরে আমি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। লোন পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমার নামে মামলাও করেছে। এখন আমি জামিনে আছি। ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে না পেরে বাধ্য হয়ে আমি এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।"
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) তথ্যানুসারে, সারাদেশে প্রায় ২০০ রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শোরুম রয়েছে। এছাড়া, ৩০০ জনের অধিক আমদানিকারক রয়েছেন।
এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার গাড়ির চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার ৮৫ শতাংশই রিকন্ডিশনড গাড়ি যোগান দেয়। এসব গাড়ির ৯৫% আমদানি হয় জাপান থেকে।
প্রায় এক লাখ লোক জড়িত আছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসার সাথে। করোনার পর থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ পুরাতন গাড়ির আমদানি কমেছে, বিক্রিও কমেছে ৪০ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে এ খাতে লোকসান হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
সংগঠনটির মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সব মিলিয়ে দেশে ২৩ হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়। পরের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) আমদানি প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। ঐ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ সাড়ে ১২ হাজারে নেমে আসে।
সর্বশেষ গত অর্থবছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে। গত জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চার হাজারেরও কম রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়েছে।
অন্যদিকে, রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি কমে যাওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও (এনবিআর) শুল্ক কর প্রাপ্তি অর্ধেকে নেমেছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি খাতে তারা দুই হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা আদায় করে। পরের বছর তা এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকায় নামে।
গত অর্থবছর, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি থেকে রাজস্ব বোর্ড এক হাজার ২০০ কোটি টাকায় মতো আদায় করেছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স এন্ড ডিলার্স এসোসিয়েনের (বারভিডা) সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "গত বছর অনেক বেশি মন্দার তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে সামান্য বিক্রি বেড়েছিল। কিন্তু, চলতি বছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের লকডাউনে তা আবার কমে যায়। বর্তমানে আমাদের ব্যবসায় তেমন কোন উন্নতি দেখছি না।"
তিনি দাবি করেন, "এ খাতের প্রায় ৯৫ শতাংশ ব্যবসয়ীর আছে ব্যাংক ঋণ। লকডাউনে সারাদেশের শোরুমগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। শোরুমগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মচারি চাকরি হারিয়েছে।"
প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শোরুম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা পায়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"এ খাতকে পুনরুদ্ধারের জন্য করোনার শুরু থেকে ১০০০ কোটি টাকার একটি ঋণ সহায়তা প্যাকেজের অনুরোধেও সাড়া দেয়নি সরকার," বলেন শহীদুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, "লকডাউনের তিন মাস অনেক আমদানিকারকের গাড়ি বন্দরে আটকা ছিলো। এ তিন মাসের বন্দর ভাড়া সরকার জোর করে আমাদের থেকে আদায় করেছে, কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে করোনায় বন্দর ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে।"
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক বলেন, "একদিকে করোনার ভয়াবহ ধস, অন্যদিকে রিকন্ডিশন্ড ও নতুন গাড়ির শুল্কায়ন মূল্যে নানা বৈষম্যের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন গাড়ির চেয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শুল্ক-কর কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা ও ক্রেতা কমেছে এবং আমদানি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে, এ খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।"
তিনি আরও বলেন, "পুরাতন গাড়ি আমদানি খাতে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় হয়। বর্তমানে পুরাতন গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ১২৮ থেকে ৮২৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। এত উচ্চশুল্ক আর অন্য কোনো দেশে নেই। সরকারের প্রতি আহবান লকডাউনে বন্দরে আটকে পড়ার গাড়ির জন্য ইম্পোর্টাদের কাছ থেকে নেয়া তিন মাসের বন্দর ভাড়া ফিরিয়ে দেয়া হোক।"
"আমদানি শুল্ক কিছুটা কমানো ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পেছানো হোক এবং এ খাতের ইম্পোর্টার ও ডিলারদের জন্য সরকার থেকে আর্থিক প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হোক। তা না হলে, করোনায় এই খাত লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে না" বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "করোনায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ খাতের লোকজন সরাসরি উৎপাদনে জড়িত নয়, এরা বিক্রেতা- এই যুক্তিতে বৈশ্বিক দুর্যোগে তাদের প্রণোদনা না দেয়া সমীচীন নয়।"
"তারা সরকারের রাজস্ব খাতে অবদান রাখছে। সরকারের উচিত অন্যান্য খাতের মতো তাদেরও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে টিকে থাকতে সহায়তা করা। অন্যত্থায় এ খাতে আরো বেশি ধস নামবে," বলেন তিনি।
এ খাতে কেন প্রণোদনা দেয়া হয়নি? - এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে যারা সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত অর্থাৎ উৎপাদনকারী- কেবল তাদেরকেই প্রণোদনা সহায়তার জন্য তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করার বিধান সরকারের। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসায়ীদের অনেকে প্রণোদনার জন্য এসেছেন, কিন্তু সরকারের বিধান অনুসারে এ খাতে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া সম্ভব হয়নি।"
এদিকে, ১৫৫টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি লকডাউনের পর থেকে দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকায় গাড়িগুলো নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তবে, করোনা দুর্যোগের আর্থিক ক্ষতি ও বাজার স্থিতিশীলতার কথা বিবেচনা করে আগামী সাত মাস (ডিসেম্বর) পর্যন্ত নিলাম স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডা।