খুলনায় শহরের বর্জ্যে বিষাক্ত নদীর পানি
ভৈরব-রূপসা নদীর মিলনস্থলে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা মহানগরী। রূপসা নদী থেকে একটি শাখা নদ 'ময়ূর' নামে প্রবেশ করেছে এই শহরের অভ্যন্তরে। শহরের মানুষের সৃষ্ট বর্জ্যের সবটুকু নিষ্কাশনের ক্ষমতা নেই খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি)। ফলে প্রতিদিন কঠিন বর্জ্যের একটি বড় অংশ নালা-নর্দমার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাচ্ছে এই তিনটি নদীতে। যার ফলে নদীর পানিতে দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এই তিনটি নদীর মধ্যে ময়ূর নদ বদ্ধ থাকায় সেখানে দূষণের মাত্রা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুটি গবেষণাপত্র ও পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের 'রিভার ওয়াটার এনালাইসিস শিট' থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা – ১৯৯৭ অনুসারে অভ্যন্তরীণ ভূপৃষ্ঠের পানির বিশুদ্ধতার মানদন্ড নির্ধারণ করা হয় সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণ রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা ও পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদানের পরিমাণের উপর। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপ থেকে দেখা যায়- ওই পানিতে বিশুদ্ধতার মানদন্ড আদর্শ সীমার চেয়ে বহুগুণ দূরে।
দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ (ডিও)
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা রয়েছে প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। যদিও ডিও'র আদর্শ মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত। পানিতে ডিও'র মাত্রা কম হওয়ায় এই নদীর পানি জলজ প্রাণী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে তাদের প্রতিবেদনে লেখা হয়।
ময়ূর নদের পানিতে প্রতিদিন যেসব কঠিন বর্জ্য মিশে যাচ্ছে, তা জারণের মাধ্যমে বিনষ্ট হতে প্রচুর পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। ফলে ওই পানির ডিও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
প্রাণ রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি)
পানিতে মিশ্রিত বর্জ্যকে বিয়োজিত করতে অণুজীবসমূহের যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার হয়, তাকে বিওডি বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পানির আদর্শ বিওডি হল প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রাম। এই মান ১০ এর উপরে গেলে সেই পানিকে দূষিত পানি হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু বর্তমানে ময়ূর নদের পানির বিওডি'র মাত্রা প্রতি লিটারে ৭৮ থেকে ৮৬ মিলিগ্রাম; যা আদর্শ মানদন্ডের সীমার চেয়ে বহুগুণে বেশী।
পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদান (টিডিএস)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, পানিতে দ্রবীভূত ভৌত উপাদানের আদর্শ পরিমাণ (টিডিএস) প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রাম। আর এই মাত্রা এক হাজারের উপরে গেলে সেই পানিকে মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী ধরা হয়। কিন্তু ময়ূর নদের প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ৬০৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত টিডিএস পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, "খুলনায় সবচেয়ে বেশি দূষণ এখন পানিতে। বিশেষ করে শহরের পার্শ্ববর্তী নদীর পানির মান অনেক বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর ময়ূর নদের পানিতে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।"
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা
ময়ূর নদের পানি নিয়ে ২০১৩ ও ২০২০ সালে পৃথক দুটি গবেষণা করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এই গবেষণা দুটির নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলিপ কুমার দত্ত।
তিনি বলেন, '২০১৩ সালের গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, ময়ূর নদের পানিতে অতিমাত্রায় টিডিএস রয়েছে। ফলে ওই পানি বেশ দূষিত ও গন্ধযুক্ত ছিল। তবে ওই নদের মাটির যেসব গুণাগুণ পাওয়া গিয়েছিল, তা কৃষিকাজের জন্য বেশ উপযোগী ছিল। কেসিসি বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকলে এ নদীর পরিবেশ ভালো থাকতো। ২০২০ সালের আমাদের গবেষণাটি ছিল মূলত খুলনা শহরের পানির নিরাপত্তা নিয়ে। এ গবেষণায় আমরা পেয়েছিলাম, খুলনা শহরের পানির চাহিদা মেটাতে ময়ূর নদকে বিশুদ্ধ পানির আধার হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।"
তিনি আরও জানান, খুলনার বিল পাবলা এলাকা থেকে রূপসার আলুতলা পর্যন্ত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এই নদের প্রায় ৪০ বর্গমিটার জায়গা আছে। রূপসার আলুতলায় ১০ বেন্টের একটি গেট নির্মাণ করে এই নদটিকে বদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে এখানে কোনো জোয়ার-ভাটা হয় না। খুলনা শহরে মধ্যে এই নদের ৬টি শাখা ছড়িয়ে রয়েছে। শহরের গৃহস্থালি ও বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানির ৮০ শতাংশ ২২ টি ড্রেনের মাধ্যমে এই নদে পতিত হয়। ফলস্বরূপ, এ নদের দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।
অধ্যাপক দিলিপ কুমার দত্ত বলেন, 'এই নদটি সংস্কার করে বর্ষা মৌসুমে স্বাদু পানি ধরে রাখা যেতে পারে। সেই পানি দিয়ে শহরের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যাবে।'
শহরে বর্জ্য পড়ছে নদীতে
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারবেন্সি অফিসার মো. আব্দুল আজিজ বলেন, "শহরে প্রতিদিন প্রায় ১২০০ থেকে ১২৫০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরী হয়। যার মধ্যে মেডিক্যাল বর্জ্য থাকে প্রায় ৪ থেকে ৪.৫ টন। এর মধ্য থেকে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা ৮০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ফেলে দিয়ে আসে। বাকি ৪০০ থেকে ৪৫০ টন বর্জ্য ড্রেন বা ফাঁকা জমিতে ফেলে দেয় শহরের মানুষ।"
আব্দুল আজিজের ভাষ্যে, শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই তাদের। তাই নগরবাসীর উচিত ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারী ট্রাসপোর্ট স্টেশনে ময়লা ফেলা।
খুলনাঞ্চলের নদ নদী ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, 'কেসিসি যেসব বর্জ্য সংগ্রহ করে না, তা কোনো না কোনোভাবে ড্রেনের মাধ্যমে ময়ূর, ভৈরব ও রূপসা নদীতে গিয়ে পতিত হয়। ময়ূর নদটি বদ্ধ হওয়ায় পতিত বর্জ্যে সেখানকার দূষণ বাড়ছে। শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য অবিলম্বে এই নদটি সংস্কার করে স্বাদু পানির আধার হিসেবে গড়ে তোলা উচিত।'