তিন বছর ধরে পড়ে আছে ল্যাবের যন্ত্রপাতি, ফের কেনাকাটায় নতুন প্রকল্প
শ্যামপুর কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের তৃতীয় তলার দু'টি কক্ষ ছোট বড় নানান পদের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভরা। কতগুলো টেবিলের ওপর সাজানো। কিছু মেশিনের কার্টুনই খোলা হয়নি, টেবিলের মধ্যে একটার ওপর আরেকটা স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ল্যাবের বাইরের পাশে ফেলে রাখা তিনটি উচ্চমানের ফ্রিজের একটির দরজা, ড্রয়ার নষ্ট। এটি হলো প্যাকিং হাউজের অচল ল্যাবরেটরির চিত্র।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইং এর তথ্য বলছে, ল্যাবরেটরিটিতে তিন বছর আগে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৪৫ ধরনের ৭০টি যন্ত্রপাতি কিনতে ব্যয় করা হয়েছে ৬০ কোটি টাকার বেশি। দেশে ১২৫০ জন এবং বিদেশে ৯০ জন কর্মকর্তা (কোনো কোনো কর্মকর্তা একাধিক দেশে) প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অথচ এখন ল্যাবটি পরিচালনার জন্য কোন কর্মকর্তা নেই। যে দুয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্যাকিং হাউজে বর্তমানে কর্মরত তারা ল্যাবের বাইরের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ফলে তিন বছর ধরেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।
বর্তমানে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে মোট কর্মরত অফিসারের সংখ্যা ১৬ জন্য। যাদের মধ্যে কয়েকজন প্রকল্পের আওতায় বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু যন্ত্রগুলো পরিচালনার মত যথেষ্ট দক্ষতা তাদের হয়নি। আরও অনেকে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিন্তু তারা পদোন্নতি বা বদলির কারণে প্যাকিং হাউজের সঙ্গেই নেই।
সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, প্রকল্পের টাকায় যন্ত্রপাতি কেনে এভাবে ফেলে রাখা অপচয়ের নামান্তর।
তিনি বলেন, অনেক প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনার আগ্রহ থাকলেও এ সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আর আগ্রহ দেখা যায় না। এ বিষয়টিকে 'দুঃখজনক' বলে মন্তব্য করেন তিনি। সঙ্গনিরোধ ল্যাবের বিষয়ে আরও খোজ খবর নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের পিআরএ কনসালটেন্ট মো. আসহানউল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা অত্যাধুনিক মেশিনারিশ ক্রয় করেছি। অনেক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছি। কিন্তু বদলি ও পদোন্নতির কারণে এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এখানে নেই। যে কারণে ল্যাবরেটরিটি চালু করা সম্ভব হয়নি।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১২-২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ১৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে 'বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এই প্রকল্পের আওতায় ল্যাবটি করা হয়েছে। কিন্তু চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে ল্যাবটির আরও যন্ত্রপাতি কেনা, আরও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ল্যাবটি চালু করা এবং ভবনের সংস্কারের জন্য ১৫৩ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্প সম্প্রতি একনেকে পাস হয়েছে।
প্রকল্পটির নতুন নাম দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর। সবজি ও ফলমূল জাতীয় পণ্যের ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ-জীবাণুমুক্ত পণ্য রপ্তানি করে আমদানিকারক দেশের আস্থা র্জন ও প্রতি বছর ২৫-৩০ শতাংশ হারে রপ্তানি বাড়ানো।
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে সবজি ও ফলমূল রপ্তানি ১৬৪.৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ২০২০-২১ এ ১১৯.৩১ ডলারে নেমেছে। যদিও এই সময়ে করোনার বিস্তার রোধে কয়েকমাস রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা জানিয়েছে রপ্তানিকারকরা।
সাধারণত সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য প্যাকিং হাউজটি ব্যবহার করা হয়। এখানে রপ্তানিকারকরা পণ্যগুলো এনে মান যাচাই-বাছাই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য কাজ করে। প্যাকিং করার পর পণ্যগুলো এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
সরেজমিন কেন্দ্রিয় প্যাকিং হাউজ ঘুরে দেখা গেছে, ভবনের নীচতলা ও দুতলায় পণ্য যাচাই বাছাই, পরিষ্কার, ধোয়া ও শুকানোর জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। প্রয়োজনে ৪-৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্যও নিচতলা ও দোতলায় কয়েকটি কুলিং কক্ষ রয়েছে। আর ভবনের তিনতলায় স্থাপন করা হয়েছে ল্যাবরেটরিটি।
ল্যাবটিতে কোন টেবিলের ওপর সারি সারি যন্ত্রপাতি সাজানো থাকলেও সেগুলো পলিথিন বা কার্টুনের প্যাকেট দিয়ে আবৃত। দুটি কক্ষের একটি মাইক্রোবায়োলজিকাল টেস্ট এবং অন্যটি রাখা হয়েছে কেমিক্যাল টেস্ট এর জন্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতিগুলো পোল্যান্ড, জাপান, জার্মাানি সহ বিভিন্ন দেশের সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের। সেগুলো প্রায় তিন বছর ধরে স্রেফ পড়ে রয়েছে।
প্যাকিং হাউজের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সালে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যন্ত্রগুলো দিয়ে গেছে। ওভাবেই পড়ে রয়েছে। পরিচালনার জন্য টেকনিক্যাল পারসন না থাকায় ল্যাবটি চালু হয়নি।
প্যাকিং হাউজের উপপরিচালক মো. লুৎফর রহমান টিবিএসকে বলেন. 'প্রকল্পটি ২০১৯ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ল্যাবটরির কার্যক্রম আর আগায়নি। যেসব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তারাও এখন প্যাকিং হাউজে কর্মরত নেই। তবে সম্প্রতি একজন ইঞ্জিনিয়ার ও একজন কীটতত্ববিদকে পদায়ন করা হয়েছে, তারা প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতিগুলো যাচাই বাছাই শুরু করেছে।'
তিনি বলেন, যাচাইবাছাইয়ের আগে বলার উপায় নেই মেশিনারিজগুলোর মধ্যে কোনটা নষ্ট হয়েছে কিনা।
এদিকে ল্যাবটি চালু না হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের। ইউরোপের যে কোন দেশে সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য নিয়মিতই সালমোনেলা'সহ যে কোন ধরনের দূষণ, কীটনাশকের রেসিডিউ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ রয়েছে কিনা, বিভিন্ন ধরনের এমআরএল পরীক্ষা করতে হয়। ল্যাবটিতে সব পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যেগুলো এখন বেসরকারি বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে।
সেন্ট্রাল প্যাক হাউজে পণ্য রেখে একটি ল্যাবে গিয়ে টেস্ট করে রিপোর্ট এনে তবেই তারা পণ্য রপ্তানি করতে পারে। সময় বেশি লাগায় পণ্যের মানের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে পরীক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। পণ্যভেদে হিট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট সহ বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়। এসব প্রযুক্তির সবগুলোই ল্যাবটিতে রয়েছে। কিন্তু ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, এতে করে তারা বিশ্ববাজারে রপ্তানিতে বেশ পিছিয়ে পড়ছেন এবং দেশেও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল, অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বলেন, "ইউরোপ আমেরিকাতে পণ্য রপ্তানির জন্য অনেক পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। যেগুলো বাইরে থেকে করতে হয়। কিন্তু ল্যাব স্থাপনের পর থেকে যদি প্যাকিং হাউজে এটি করা যেত তাহলে আমাদের সময় ও সক্ষমতা দুটোই বাড়তো। আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। সরকার নতুন প্রকল্প নিয়েছে দেখা যাক কত দ্রুত ল্যাবটি চালু করতে পারে।"
নতুন নেয়া এই প্রকল্পের আওতায় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রমে পণ্যে বালাই সনাক্ত করতে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি তৈরির কথা বলা হয়েছে। একই প্যাকিং হাউজের ল্যাবরেটরি ভবনের ৩৩১৫ বর্গফুট সম্প্রসারণ ও ভৌত অবকাঠামো মেরামত করা হবে। ল্যাবরেটরিতে আবারও মাইকোলজি, ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, নেমাটোলজি, মাইক্রোবায়াল পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মোটাদাগে প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো একটি আন্তর্জাতিক মানের উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরি তৈরি করা এবং যা সারাবিশ্বে রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
এবারও স্থানীয়ভাবে ১৮০ জন্য কর্মকর্তাকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ ও ৬ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
ল্যাবরেটরিটির অবস্থা মূল্যায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ উইং এর যুগ্মসচিব তন্ময় দাসের নেতৃত্বে একটি টিম মাসখানেক আগে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারাও ল্যাবটি দ্রুত চালু করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনটি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের কাছে পাঠিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, এমন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যারা প্যাকিং হাউজে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারবে।