বড় ক্ষতিতে কুমারখালি তাঁতশিল্প
বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট আর কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এমনিতেই ধুঁকছিল তাঁতশিল্প। তার উপর মহামারির প্রভাবে ধসে গেছে কুষ্টিয়ার কুমারখালির তাঁতশিল্প। মহামারির প্রভাবে বেচা-বিক্রি না থাকায় বার্ষিক লোকসান হয়েছে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। এই শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৫০% লোক কাজ হারিয়ে বেকার। সরকারের প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও প্রণোদনা পায়নি বললেই চলে। ক্ষতিগ্রস্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, দোকান ভাড়া, কারিগর-শ্রমিকদের বেতন ইত্যাদি ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা, সরকারের সহযোগিতা না পেলে এ ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
কুষ্টিয়া তাঁত বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় একসময় ৮০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার ছিল। এর মধ্যে খটখটি তাঁত ১৫ হাজার, হস্তচালিত প্যাডেলিং তাঁত ৪৫ হাজার ও বিদ্যুচ্চালিত ২০ হাজার। এরা দেশের মোটা কাপড়ের চাহিদার ৬৩ ভাগ পূরণ করত, কোভিডের আগ পর্যন্ত ৩৫ ভাগ পূরণ করে চলছিল, বর্তমানে তা ৩০ ভাগে নেমে এসেছে।
কুমারখালি ফ্যাক্টরি সমিতির তথ্যমতে, কুমারখালিতে প্রায় ১০০০ তাঁত কারখানার ৪০০ই করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ খাতের ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৭০-৮০ হাজার করোনায় কাজ হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করছে। স্বাভাবিক সময়ে দুই কোটি ৯০ লাখ পিস লুঙ্গি, ১৫ লাখ পিস বেড কভার, ৭০ লাখ পিস গামছা-তোয়ালে উৎপাদন হতো, বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। বার্ষিক আয় ৩০০ কোটি টাকার জায়গায় গত বছরে হয়েছে মাত্র ১৬০ কোটি টাকা; তাছাড়া প্রায় ৯৫% ব্যবসায়ীরই ব্যাংক লোন রয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন মাসুদ রানা, তিনি রানা তাঁত ফ্যাক্টরির মালিক। ২০০৮ সাল থেকে রয়েছেন এ ব্যবসায়। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে আমার বছরে ৪০ লাখ টাকার গামছা বিক্রি হতো, গত বছর করোনার কারণে ১০ লাখ টাকারও বিক্রি হয়নি, ৫০ ভাগ মাল এখনও অবিক্রিত, বেতন দিতে না পারায় ৩০ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৫ জন চলে গেছে'।
বর্তমানে রানা তার ১৫ লাখ টাকা ব্যাংক লোন কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন এবং এই নিয়ে ব্যবসায় সামনের দিনগুলোতে আরো অন্ধকার দেখছেন বলে জানান মাসুদ রানা।
৩২ বছর কুমারখালি আলম টেক্সটাইলে তাঁত কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন আতিয়ার রহমান। করোনায় তাঁত কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েন তিনি। টিবিএসকে বলেন, 'করোনায় বেচাকেনা না থাকায় তাঁত মিল বন্ধ করে দিয়েছে মালিক, আগে মাসে ৮ হাজার টাকা আয় করতাম, জীবনে অন্য কোন কাজ আর শিখিনি, কাজের জন্য তাঁত মালিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, কিন্তু পাচ্ছি না! এখন আমি সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি'।
সাধারণত কুমারখালিতে বিভিন্ন সাইজের চাদর, বেড শিট, বেড কভার, লুঙ্গি, গামছা, জায়নামাজ, হাতের রুমাল ইত্যাদি তাঁতপণ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে।
জানা যায়, ১৭৪২-৪৩ সালে ঢাকার সোনারগাঁ-বিক্রমপুর প্রভৃতি অঞ্চলে মারাঠা বর্গিদের উৎপাতে জেরবার হয়ে অনেক তাঁতি সুতা কাটুনি দলে দলে নদীয়ায় (বর্তমান কুষ্টিয়ায়) চলে যায়। দেশভাগের আগে কুমারখালি ছিল অবিভক্ত নদীয়ার একটি নিরাপদ জনপদ।
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটি কুঠি খোলে। উদ্দেশ্য ছিল, দিনেমার ফরাসি আর ওলন্দাজদের সাথে পাল্লা দিয়ে এখানকার কাপড় দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি বাজার দখল করা। একেকটা বাণিজ্যিক কুঠির অধীনে অনেকগুলো বস্ত্র সংগ্রহ কেন্দ্র বা আড়ং ছিল। এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্তও এই তাঁত কাপড়ের চাহিদা ব্যাপক ছিল। কিন্তু দিনদিন এ তাতঁশিল্প ক্ষয়ের দিকে।
বন্ডের মাধ্যমে বিদেশি সুতা ও কাপড় আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এবং বিপরীতপক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে তাঁত শিল্পকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন না করতে পারায় খুব একটা আগের মতো পোষাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
কুমারখালি শহরের শেরখান্দি এলাকায় সুতার দোকান রয়েছে হাবিবুর রহমান নিপুনের। তিনি বলেন, করোনায় বর্তমানে দেশীয় বাজারেও সুতার দাম বেড়ে গেছে,করোনার আগে ২০ কাউন্টের সুতার দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা,তা এখন ১০৭ টাকা।
তিনি আরো বলেন, 'করোনায় কিছু তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় আমার সুতা বিক্রি অর্ধেক কমে গেছে, স্বাভাবিক সময়ে আমি বছরে ৯-১০ কোটি টাকার সুতা বিক্রি করতাম, এবার ৫ কোটি টাকারও পারি নি'।
তিনি আরও বলেন, 'এ খাতকে বাচাঁতে হলে সরকারকে অতিবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা দিতে হবে, তাঁতীদের অত্যাধুনিক মেশিনারিজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাদের ব্যাংক লোন রয়েছে তাদের কিস্তির মেয়াদ আরো ছয় মাস পিছিয়ে দিতে হবে'।
এছাড়াও বন্ড লাইসেন্স বাতিল, সকল ব্যবসায়ীর জন্য ৫% ইন্টারেস্টে সুতা আমদানির নিয়ম এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতায়ন ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে আধুনিকায়নের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান টিবিএসকে বলেন, 'কুমারখালিতে বিসিক পাঁচশ একর জমি নিয়ে নতুন এক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে, সে জমিতে তাঁতশিল্পের জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দ রাখা হবে। আমরা ইতোমধ্যে ১৭৫টি তাঁত কারখানাকে আর্থিক সহায়তার জন্য শনাক্ত করেছি, যদিও তা ক্ষতির তুলনায় খুবই সামান্য'।
কুমারখালীর তাঁতশিল্পের প্রাণ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে বছর ১১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচটি বিসিক সেন্টারে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও একটি ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট, এবং তাঁতপণ্য বিপণন সহজ করতে ঢাকার কারওয়ান বাজার ও কুষ্টিয়ার কুমারখালির বাজারে স্থায়ী মার্কেটে প্রমোশন কেন্দ্র স্থাপন নির্মাণের উদ্যোগ নিতে।
এসব প্রকল্পের অগ্রগতি কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁত বোর্ড কুষ্টিয়া শাখার সহকারি মহাব্যবস্থাপক মেহেদী শেখ টিবিএসকে বলেন, 'করোনার কারণে আমরা পুরোদমে কাজ শেষ করতে পারিনি, তবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউটের কাজ স্বল্প পরিসরে চলছে। এছাড়া তাঁতশিল্প আধুনিকায়নের জন্য 'ফ্রী সার্ভিস সেন্টারের' ৯০% অত্যাধুনিক মেশিনারিজ বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, আশা করি আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে তা চালু হলে বিদ্যুত সমস্যাসহ অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত বেকার তাঁতীরা প্রশিক্ষণ নিতে পারবে, বর্তমানের তুলনায় তিনগুণ উৎপাদন করা সম্ভব হবে'।
এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা তাতঁ খাতকে প্রণোদনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছি, কিন্তু স্থানীয় তাঁত মালিকদের সাথে যোগাযোগের ঘাটতির কারণে অধিকাংশই প্রণোদনা নিতে পারেনি, তারপরও তাঁত শিল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের নতুন করে তালিকা করে প্রণোদনা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো'।
থ্রি ব্রাদারস লুঙ্গি লিমিটেডের মালিক আবদুস সামাদ টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর আমি মাত্র ১২ লাখ টাকার লুঙ্গি বিক্রি করতে পেরেছি, অথচ স্বাভাবিক সময়ে ৩০- ৪০ লাখ টাকার বিক্রি হতো অনায়াসে। ২০ লাখ টাকা ব্যাংক লোন রয়েছে, ইনকাম না থাকায় ঠিকমতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারিনি গত এক বছর। কিন্তু সরকারের প্রণোদনার একটি টাকাও আমি সহযোগিতা পাইনি'।
আধুনিক ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, স্বল্প সুদে অর্থায়ন, আইসিটি, ই-কমার্স, ই-মার্কেটিং ইত্যাদি সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; তাহলে কুমারখালি হোম টেক্সটাইল অদূর ভবিষ্যতে দেশের একটি অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে জানান তিনি।