সৌদিতে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার ধরতে চায় বাংলাদেশ
সাতটি সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে সৌদি আরবের বাজার ধরতে চাইছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- খাবার ও বেভারেজ, পোশাক, পাট ও চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি। সৌদি আরব এ পণ্যগুলো বর্তমানে বিশ্ববাজার থেকে কিনতে বার্ষিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে।
এ বাজারে সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যাল, ও প্লাস্টিক পণ্যেরও ভালো চাহিদা রয়েছে। আর এক্ষেত্রে ঢাকা'র বাণিজ্য ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম।
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে, আগামী ৬-৮ অক্টোবর রিয়াদে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় 'বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মেলা-২০২২'-এ নিজের সক্ষমতা জানান দিতে চায় ঢাকা। সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো'র (ইপিবি) এক চিঠিতে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশে কিছু নতুন বিনিয়োগ আনাও এ প্রদর্শনীর আরেকটি উদ্দেশ্য থাকবে। এভাবে বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনীর আয়োজন করে ইপিবি চাচ্ছে নতুন নতুন বাজারের অনুসন্ধান চালাতে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর নির্ভরতা কমাতে।
একইভাবে নতুন বাজারের সন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। তার অংশ হিসেবে আগামী বছর চীন, জাপান, ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বাণিজ্য বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে এ দেশগুলোতে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে। বিজিএমইএ-এর আরও উদ্দেশ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন রপ্তানি আদেশের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার (আইটিসি)-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২১ সালে সৌদি আরবের আমদানি ছিল ১৫২.৩৪ ডলার। দেশটিতে চীন সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকে, যার পরিমাণ ৩১.০৭ বিলিয়ন ডলার। এরপরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, ও জার্মানি।
অন্যদিকে ইপিবি'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে কেবল ২৯০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি ছিল ১৪৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২টি রপ্তানি গন্তব্যের মধ্যে সৌদি আরব বাংলাদেশের ২৪তম বড় রপ্তানি গন্তব্য। একইসাথে সৌদি আরব দেশের পোশাকখাতের ২৬তম বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য।
তবে রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইপিবি'র উপাত্তে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রকৃত তথ্য নেই। তাদের ধারণা, রপ্তানির অংক বাস্তবে আরও উচ্চ। তারা বলছেন, ব্যক্তিউদ্যোগেও কার্গো বা ব্যাগেজের মাধ্যমে সৌদি আরবে ভালো পরিমাণ পণ্য যায় বাংলাদেশ থেকে। অনানুষ্ঠানিক এ রপ্তানি প্রক্রিয়ায় পণ্যের মূল্য না পাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি এমন একটি সম্ভাব্য বাজারের সন্ধানে আমরা সৌদি আরবের এ প্রদর্শনীতে যোগ দিতে যাচ্ছি।'
বর্তমানে, বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারীরা সৌদিভিত্তিক কিছু বাংলাদেশি বিক্রেতার মাধ্যমে রপ্তানি করছে। তাদের বেশিরভাগই রপ্তানিকারকদের সাথে প্রতারণা করে। বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা করায় রপ্তানিকারকদের দাম আদায়ের কোনো উপায় থাকে না।
এই প্রদর্শনী সৌদি আরবের খুচরা বিক্রেতাদের সাথে সরাসরি ব্যবসার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানান, তাদের ১৫ সদস্যের এই প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। সৌদি উপসাগরীয় দেশগুলোয় প্রভাবশালী হওয়ায় প্রদর্শনীটি এ অঞ্চলের অন্যান্য বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে।
বেশিরভাগ পোশাক পণ্য চীন, ভারত, তুরস্কসহ অন্যান্য উৎস থেকে কেনে সৌদি আরব। 'বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক হওয়ার পরও, এ বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত'- উল্লেখ করেন আজিম।
তিনি বলছিলেন, সরকারি উদ্যোগের অভাবের কারণে এই বাজারে একটি বিশাল সুযোগ এখনও অব্যবহৃত। এটি অন্যান্য রপ্তানি পণ্য যেমন হোম টেক্সটাইল, কৃষি পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, পাট এবং সিরামিকের জন্যও একটি বড় বাজার হবে।
আরবীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলিও উচ্চ মূল্যের পণ্য। তাই এবারের সরকারি উদ্যোগটি কমপক্ষে ৫ - ৬ বিলিয়ন ডলারের বাজার অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে মনে করছেন আজিম।
শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'বিকল্প বাজার হিসেবে এরমধ্যেই আমরা এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মুখ দেখছি'।
নতুন ক্রেতা খুঁজতে এবং সম্ভাব্য নতুন বাজারগুলি থেকে আয় বাড়ানোর জন্য, দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা এই বছরের নভেম্বরে দুবাইতে আরেকটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবেন।
জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড (হোম) এর নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) রাশেদ মোশারফ জানান, তারা সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশে তাদের নিজস্ব খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ব্যবসা করছেন।
দুবাই ভিত্তিক বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম- ল্যান্ডমার্ক গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি এই বাজারেও ভালো ব্যবসা করছে। তিনি বলেন, জাবের এবং জুবায়ের এই খুচরা বিক্রেতার জন্য তাদের কয়েকটি ব্র্যান্ড - ম্যাক্স, হোমসেন্টার, বেবিশপ এবং হোমবক্সের পণ্য প্রস্তুত করে থাকে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃষি-ভিত্তিক পণ্য রপ্তানিকারক প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা বলেন, 'আমরা উপসাগরীয় দেশগুলিতে ভালো ব্যবসা করছি। বেশিরভাগ পণ্য যাচ্ছে- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও লেবাননে।
এ বাজারে তাদের দুই অঙ্কের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাণের মোট রপ্তানির ৩০ ভাগই উপসাগরীয় দেশগুলিতে যায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৩২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে প্রাণ-আরএফএল। ২০২৫ সাল নাগাদ ১০০ কোটি ডলার রপ্তানির লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে ১০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকের বাজার এখনও অব্যবহৃত
উপসাগরীয় দেশগুলির সাথে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক থাকার পরও সরকার এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোগের অভাবে বাংলাদেশ ১০ বিলিয়ন ডলারের পোশাকের বাজার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল–সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইনের মতো উপসাগরীয় আরব দেশগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যমতে, ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববাজার থেকে প্রায় ৪৪০ কোটি ডলার মূল্যের পোশাক পণ্য কিনেছে। সৌদি আরব কেনে ৩.০১ বিলিয়ন, কুয়েত ১.১৩, কাতার ৬৬০ মিলিয়ন, ওমান ৬০৮ মিলিয়ন এবং বাহরাইন ২৭৪ মিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য।
ইপিবির তথ্যানুসারে, এই অঞ্চলে বর্তমানে মাত্র ৩৬৭.৪৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশ উদ্যোগী হলে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বার্ষিক চাহিদার ৫%, সৌদির ৪ শতাংশ এবং বাকি দেশগুলোর ১ শতাংশেরও কম চাহিদা মেটাতে পারবে বলে জানিয়েছে ব্যুরো।
এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছিলেন, উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এই বাজারের বড় অংশই দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত রয়েছে।
'বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে আমরা এসব বাজারের সম্ভাবনা খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করছি'- যোগ করেন তিনি।