প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কর দিতে উৎসাহিত করছে কেপিআই সার্ভিস লিমিটেড
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাশ করে সদ্য সিএ কোর্স (প্রফেশনাল লেভেল) সম্পন্ন করেছেন প্রিয় দে। গতানুগতিক জীবনধারার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেন এই তরুণ, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি সৃষ্টি করবে কর্মসংস্থান। এমন ধারণা থেকেই ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আয়কর সেবা প্রতিষ্ঠান কেপিআই (কি পার্ফরম্যান্স ইন্ডিকেটরস) সার্ভিস বিডি। প্রিয় দে'র প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি এখন পর্যন্ত ৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে করের আওতায় আসতে সহায়তা করেছে।
প্রান্তিক করদাতাদের মধ্যে কর সংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টি, করভীতি রোধ এবং নতুন করদাতা সৃষ্টিতে প্রিয় দে একটি বিজনেস মডেল নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রান্তিক পর্যায়ে এই মডেল ছড়িয়ে দিতে সমাজে প্রভাববিস্তারকারী শিক্ষকদের টার্গেট করে শুরু করেন কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু করেন আয়কর বিষয়ক কর্মশালা।
১ লাখ টাকা প্রারম্ভিক মূলধন নিয়ে হিমশিম খেতে খেতে বেড়ে ওঠা কোম্পানিটির বার্ষিক টার্নওভার এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত উপজেলায় কর্মশালার মাধ্যমে আয়কর বিষয়ক নিয়মনীতি, কর পরিকল্পনা, টিআইএন রেজিস্ট্রেশন, আয়কর রিটার্ন পূরণ ও অর্থ আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেশন পরিচালনা করে আসছে।
গত চার বছরে পাঁচশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয়কর কর্মশালা পরিচালনা করেছে কেপিআই।
প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই বছরেই কেপিআই ৩ হাজার নতুন করদাতা সৃষ্টি করে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক হাজার করে নতুন করদাতা সৃষ্টি করছে এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কোম্পানির মোট গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৫৬ জনে।
নতুন করদাতা সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষকদের বিনামূল্যে টিআইএন রেজিস্ট্রেশনও করে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজারেরও বেশি আয়কর ফাইল জমা দিয়েছে কেপিআই। এরমধ্যে স্কুল কলেজ মাদ্রাসার শিক্ষকদের আয়কর ফাইলের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৫০০। বাকি গুলো অন্যান্য আয় খাতের করদাতা।
জমা দেওয়া আয়কর ফাইলের ৮০ শতাংশই চট্টগ্রাম বিভাগের। বাকি ২০ শতাংশ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। এসব ফাইল থেকে সরকারের আয়কর আদায় হয়েছে ৬ কোটি টাকারও বেশি।
২০২১ সালে বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক থেকে লিমিডেট কোম্পানিতে রুপান্তরিত হয়ে কেপিআই সার্ভিস লিমিটেড নামধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ৩ টি অফিসে কেপিআইতে কাজ করছেন ১০ জন কর্মকর্তা।
আয়কর ছাড়াও ভ্যাট কনসালটেন্সি, ম্যানেজমেন্ট অডিট, অ্যাকাউন্টিং সার্ভিস, কর্পোরেট এডভাইজরির মতো বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করছে এই প্রতিষ্ঠান।
কেপিআই প্রতিষ্ঠাতা প্রিয় দে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার শেখের হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৩ জন শিক্ষকের আয়কর ফাইল জমা দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয় কেপিআই'র। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য প্রান্তিক পর্যায়ে করভীতি দূরীকরণ, করনেট সম্প্রসারণ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং সর্বপরি জনগণের মাঝে আয়কর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।"
তিনি বলেন, "কেপিআই প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজেলায় প্রায় ৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মশালা করেছি। কর্মশালা আয়োজনে সহায়তা করেছে উপজেলা শিক্ষা অফিস, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের সমন্বয় সভায় কর্মশালাগুলো কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।"
চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, পটিয়া, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া এবং খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা, গুঁইমারাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কেপিআই'র কার্যক্রম প্রসারিত হয়েছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলা উপজেলায় এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করছে কেপিআই সার্ভিস লিমিটেড।
কেপিআই জানিয়েছে, সাতটি মূল্যবোধ বা সেভেন সি (যেমন- কর্পোরেট এথিকস, কমিটমেন্ট, কনফিডেন্সিয়ালিটি, কর্পোরেট বিহ্যাভিওর, ক্লায়েন্ট স্যাটিস্ফ্যাকশন, কম্পেটেন্স, কর্পোরেট স্পেশ্যাল রেস্পনসিবিলিটি)-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।
এ প্রতিষ্ঠনের বিষয়ে আয়কর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়কর বিধি মোতাবেক নানান সেবায় আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে কারণে অনেকের কাছে আয়কর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেকের আবার আয়কর বিষয়ে সাম্যক ধারণা না থাকায়, আয়কর নিয়ে ভীতি কাজ করে। এক্ষেত্রে কেপিআই সার্ভিস লিমিটেড স্ব উদ্যোগী হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে আয়কর সেবা দান করছে। এটি অবশ্যই প্রসংশনীয় উদ্যোগ। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেশের রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তারা।
সীতাকুণ্ডের শেখের হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বকর বলেন, "আমরা ২০১৮ সালের আগে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতাম না। কেপিআই আমাদের স্কুলে এসে আয়কর বিষয়ে কর্মশালা করে। এতে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুলের শিক্ষকরা এখন নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করছি।"
"আয়কর নিয়ে আমাদের মাঝে একসময় ভীতি কাজ করলেও এখন আর সেটি নেই। কেপিআইএ'র এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই," যোগ করেন প্রধান শিক্ষক।
মিরসরাই উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফজলুল হক জানান, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মতোই আয়কর সেবা প্রদান করছে কেপিআই। আয়কর সেবা গ্রহীতারা আগে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেবা নিতো। এখন স্কুলে এসে কেপিআই সেবা প্রদান করছে।
"করদাতাদের দোরগোড়ায় আয়কর সেবা পৌছে দেওয়ার এই উদ্যোগ প্রসংশনীয়। এটি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে," বলেন ফজলুল হক।