আদানি বনাম হিন্ডেনবার্গ: শর্ট সেল কী? পুঁজিবাজারে ‘ভালুক’দেরই কি দানব বলতে হবে?
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্বনামধন্য শর্ট সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ, তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবমিলিয়ে মাত্র এক ডজন। কিন্তু, তারাই এশিয়ার সর্বোচ্চ এবং বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানিকে ধসিয়ে দিয়েছে।
গত ২৪ জানুয়ারি এক্টিভিস্ট গবেষণা ফার্মটি আদানি গ্রুপের শেয়ার নিয়ে তাদের অনুসন্ধানী বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ খাতে ভারতের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের নয়টি প্রধান কোম্পানির বাজারমূল্য অর্ধেকের বেশি কমেছে। ২৪ জানুয়ারি সম্মিলিত বাজারমূল্য ২৩৪.৭১ বিলিয়ন ডলার থাকলেও, গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) নাগাদ তা ১১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে বলে জানা যায় মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি সূত্রে।
ফলে শিল্পগোষ্ঠীটির চেয়ারম্যান গৌতম আদানি বর্তমানে এমনকী বিশ্বের সেরা ২০ ধনীর কাতারেও নেই বলে গত শুক্রবার জানায় ফোর্বস ও ব্লুমবার্গ।
হিন্ডেনবার্গ প্রকৃতপক্ষে আদানি গ্রুপের শেয়ারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে কিছু ফাঁকফোকর খুঁজে পায়, যার সুবাদে পরিবারের সম্পদমূল্য ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আদানি শেয়ারের এই স্ফীতির বিরুদ্ধেই বাজি ধরে তারা।
হিন্ডেনবার্গ যা করেছে?
হিন্ডেনবার্গ আদানি গ্রুপের একটিও শেয়ার বিক্রি করেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ডেরিভেটিভ বাজারে থাকা বিকল্পগুলোর মাধ্যমে আদানির শেয়ারের বিরুদ্ধে বাজি ধরেছিল।
ফলে আদানির শেয়ারমূল্য যত কমেছে, হিন্ডেনবার্গও ততো বেশি মুনাফা করেছে।
আদানি গ্রুপের শেয়ারের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে হিসাব জালিয়াতি, বাজারে কারসাজিসহ অন্যান্য অসাধুতার বিস্তৃত এক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে হিন্ডেনবার্গ।
বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া যেমন ছিল
হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশ এবং তাদের শর্ট সেলের আত্মপ্রত্যয়ী ঘোষণার পর ভারতীয় ব্রোকারেজগুলোয় আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিক্রির হিড়িক শুরু হয়।
কিন্তু, কোনো বিনিয়োগকারী যদি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটিকে আমল না দিতেন, তাহলে হিন্ডেনবার্গ কোনো আয় করতে তো পারতোই না, বরং এক্ষেত্রে হয়তো লোকসানের মুখ দেখতো।
শর্ট সেল কী?
বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই যখন শেয়ারের বাজারমূল্যে আস্থা রাখেন, তখন কীভাবে ওই স্টকের বিরুদ্ধে বাজি ধরতে হয়– সেটাই এখানে মূল প্রশ্ন।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সবচেয়ে প্রচলিত ধরন হলো- কম দামে কিনে, বেশি দামে বিক্রি করে পুঁজি বৃদ্ধি করা এবং আবার শেয়ারটির দাম কমার অপেক্ষা করা। অন্যদিকে, শেয়ারের মূল্য পতন থেকে সক্রিয়ভাবে লাভ করে শর্ট সেলাররা।
শর্ট সেল হলো- অন্যদের থেকে কোনো কোম্পানির শেয়ার ধার করে তা বাজারে বিক্রির প্রক্রিয়া, এক্ষেত্রে আশা করা হয়, এগুলো পরে আরো কম দামেও কেনা যাবে। এবং প্রকৃত মালিককে তা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।
ধার করা শেয়ার বিক্রির পর এর দাম কমলে বিক্রেতা লাভ করে। আর দাম বাড়লে বাজার থেকে কিনে একই সংখ্যক শেয়ার প্রকৃত মালিককে (যার থেকে ধার করা হয়েছে) ফিরিয়ে দিতে বেশি টাকা লাগে শর্ট সেলারের, যাতে তার লোকসান হয়।
পুঁজিবাজারের শুরু থেকেই আছে শর্ট সেল
১৬ শতকের দিকে ডাচ প্রজাতন্ত্রে যখন প্রথম পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকেই শর্ট সেল আছে। ১৬১০ সালে ধস নামে ডাচ বাজারে, এই ধসের জন্য আইজ্যাক লি ম্যারি নামক এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, তিনি সক্রিয়ভাবে শেয়ার শর্ট সেল করেছিলেন।
শেয়ারের শর্ট সেল সম্পর্কে কিংবদন্তিতুল্য অনুমানের জন্য বিখ্যাত জেসি লিভারমোর। ১৯০৭ ও ১৯২৯ সালে ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজিবাজার ব্যাপক উল্লম্ফনের পর আবার ধসের শিকার হয়। এসময় তিনি বিভিন্ন শেয়ার শর্ট করে বিপুল মুনাফা করেন।
১৯৮৭ সালে মার্কিন বাজারে বিপুল স্ফীতির পর নজিরবিহীন ধস, যা ব্ল্যাক মানডে ক্র্যাশ নামেও পরিচিত; ১৯৯৯-২০০০ সালের টেক খাতের স্ফীত শেয়ারমূল্যে ধস; ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের বাজারমূল্য স্ফীতি এবং সাম্প্রতিক সময়ের প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্য স্ফীতি– সবক্ষেত্রেই তেজি বাজারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন শর্ট সেলাররা। শেয়ারমূল্য ধসের পর তাদের উচ্ছ্বাসের সীমা থাকে না।
শর্ট সেলারদের ঘৃণা করা হয় কেন?
বাজার ধসে যাদের অর্থ হারায়, তারা শর্ট সেলারকে শাপশাপান্ত করেন।
এমনকী কিছু বিশেষজ্ঞ-ও শর্ট সেলারদের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বা অগ্রগতি ও সম্পদ সৃষ্টির শত্রু বলে দোষী করেন।
আসলে এটা পুঁজিবাজারে 'বুল' ও 'বিয়ার' খ্যাত দুই পক্ষের চিরন্তন লড়াই। বুল বা ষাঁড়রা তেজি বাজার থেকে লাভ করেন, আর বিয়ার বা ভালুকেরা বাজার পতন থেকে মুনাফার সন্ধানী।
বুলরা মনে করেন, বাজারমূল্য আরো উচ্চ হওয়া উচিত, অন্যদিকে বিয়ারদের ধারণা কোনো শেয়ারের মূল্য তার প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়।
বিয়াররা কী তাহলে দুষ্টচক্র?
অর্থ হারিয়ে এমন অপবাদ অনেকে দিলেও, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা নিয়ন্ত্রকরা কিন্তু তা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না।
কারণ, বিনিয়োগকারীদের সামস্টিক উন্মাদনায় অনেক সময় পুঁজিবাজার সূচক অযৌক্তিকভাবে ব্যাপক উল্লম্ফন করে, এই চূড়া থেকে পতন আর্থিক ঝুঁকি সম্পর্কে অন্ধ হয়ে থাকা বুলদেরও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। আর্থিক ইতিহাসে এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে।
মৌলভিত্তিতে শেয়ারের মূল্য যা হওয়া উচিত, তার চেয়েও বহুগুণ উচ্চতায় যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়ে যাওয়া হয় তখন শর্ট সেলাররা হলেন এই বিপর্যয়ের আগাম সতর্কতা দানকারী। কারণ আমরা সবাই জানি, অনাকাঙ্ক্ষিত স্ফীতি বাজারের গড়পড়তা প্রায় সকল বিনিয়োগকারীর জন্য আরো বেশি বিপর্যয় ডেকে আনে।
তাছাড়া, বাজার অতি স্ফীত থাকা অবস্থায় শর্ট সেলাররা কিছু না করলেও, তা এক সময় ধসে পড়েই। যেমনটা ঘটেছিল ২০১০-১১ সালে ঢাকার পুঁজিবাজারে।
অবিকশিত কিছু বাজার বাদে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ কিছুটা সতর্কভাবে হলেও শর্ট সেলকে স্বাগত জানান এবং নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির শেয়ারে শর্ট সেল করতে দেন। এর পাশাপাশি শর্ট সেলাররা সিন্ডিকেট করে যেন বাজার ব্যবস্থা এবং সঞ্চয়কারীদের ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে, সেদিকটাতেও নজর রাখেন তারা।
তাই শর্ট সেল কতোটা নিয়ন্ত্রণে বা কতোটা নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত রাখা উচিত এনিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু তাই বলে বাজারে তাদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা-ও একেবারে অস্বীকার করা যায় না।
শর্ট সেলারদের ঝুঁকি
পুঁজিবাজারে যেটা সবচেয়ে প্রচলিত – কম দামে কেনা ও বেশি দামে বিক্রি – তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শর্ট সেলারদের ব্যবসা। একারণেই ওয়ারেন বাফেটের মতো বিশ্বসেরা বিনিয়োগকারী কোনো শেয়ার শর্ট করে বিক্রি করেন না।
তিনি বলেছেন, তাত্ত্বিকভাবে চাইলে যে কেউ কোনো শেয়ার বিপুল টাকায় কিনে নিতে পারে, কারণ সর্বোচ্চ কোন দামে কেনা যাবে- তার ওপর কোনো সীমা দেওয়া নেই। ফলে শর্ট সেলারেরও ঝুঁকি অসীম। তাছাড়া, বুলরা যদি হারে, তাহলে বাজারে তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজিই শুধু হারায়; সেটা একসময় আবার ফেরত আসার সম্ভাবনাও থাকে, কারণ শেয়ারমূল্য তো একেবারে শূন্য হয়ে যায় না।
শর্ট সেল কি বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ?
কয়েক বছর আগে শর্ট সেলের বিধিমালা প্রস্তুত করেছিল বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। তবে দুর্বল বাজার অবকাঠামো ও জ্ঞানের অভাবে এখানে আজো শর্ট সেল বৈধ করা যায়নি।
বৈশ্বিকভাবে অবশ্য বাজার অবকাঠামো দিনে দিনে এতোটা উন্নত হয়েছে যে, হিন্ডেনবার্গকে ভারতে এসে দেশটির ব্রোকারেজ হাউজে অর্থ লগ্নী করে আদানি গ্রুপের শেয়ারের বিরুদ্ধে বাজি ধরতে হয়নি।