জৌলুস হারিয়ে ধুঁকছেন হাজারীবাগের হাড্ডি ব্যবসায়ীরা
পশুর উচ্ছিষ্টের ব্যবসায় ঢাকার হাজারীবাগের হাড্ডি পট্টি সুপরিচিত। একসময় কর্মব্যস্ততায় মুখরিত ছিল এ এলাকা। কিন্তু হাড্ডি পট্টির সেই জৌলুস এখন আর নেই।
হাড্ডি পট্টিতে একসময় ২৫ থেকে ৩০টি দোকানে গরু-মহিষের হাড় বেচাকেনা হতো। অধিকাংশ দোকানই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকজন ব্যবসায়ী বাকি আছেন তারা এখন হাড্ডি সংগ্রহের পাশাপাশি ভাঙারির ব্যবসা শুরু করেছেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেথর ও কসাইরা হাড় সংগ্রহ করে দোকানে বিক্রি করেন। দোকানিরা এসব হাড্ডি মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করেন। অধিকাংশ মিল মালিকের নিজস্ব হাড় সংগ্রহের দোকানও রয়েছে।
মিলগুলোতে এসব হাড় পরিষ্কার করে শুকিয়ে গুঁড়া করা হয়। পরে গ্লোবাল ক্যাপসুলস লিমিটেডের মতো স্থানীয় ক্যাপসুলের খোসা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এই হাড়ের গুঁড়া কিনে নেয়। এরপর তারা এ হাড়ের গুঁড়া থেকে জেলাটিন তৈরি করে, যা ক্যাপসুলের খোসা তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
হাজারীবাগের হাড্ডি সংগ্রাহক জসিম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের এখানে হাড়ের ব্যবসা এখন প্রায় বন্ধ। কোরবানির পর কিছু হাড় পাওয়া যায়, তাছাড়া বছরের অন্য সময় আমাদের হাড়ের ব্যবসা বন্ধ। আগে প্রতি মাসে ছোট ব্যবসারীরাও ৭ থেকে ৮ টন হাড় বিক্রি করতাম। কিন্তু তা এখন মাসে ১ টন হলেও অনেক বেশি।'
হাজারীবাগের হাড্ডি মিল আবিদ এন্ড ব্রাদার্সের মালিক ভোলা মিয়া এ ব্যবসার অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করেন।
ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়েনি প্রক্রিয়াজাত হাড়ের দাম। ভোলা মিয়ার মতো হাড় প্রক্রিয়াজাতকারীদের মুনাফার মার্জিন কমে যাওয়ায় সংগ্রাহকদের কাছ থেকে হাড় কেনার সক্ষমতা কমে গেছে তাদের।
ভোলা মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'স্বাধীনতার আগে থেকে আমি এ ব্যবসার সাথে জড়িত, কিন্তু এখনকার মত এত খারাপ অবস্থা আমাদের আর কখনও হয়নি। আগে আমার একটা প্রাইভেট কার, রেন্ট এ কার, তিনটি কারখানা ছিল; আর এখন আমি নিঃস্ব।'
তিনি আরও বলেন, 'বছর পাঁচেক আগেও আমি মাসে অন্তত ৫০ টন, আর কোরবানিসহ প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টন হাড় সংগ্রহ করতাম। কিন্তু এখন কোরবানিসহ পুরো বছরে ২০০ টন হাড় সংগ্রহ করেতে পারি না।'
ব্যবসার খারাপ অবস্থার কারণ হিসেবে ভোলা মিয়া জানান, করোনার পর থেকেই ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। করোনার মধ্যে সরকারের কোনো প্রণোদনা না পাওয়া, একবার আগুনে তিনটি গোডাউন পুড়ে যাওয়ার পর কোনো প্রণোদনা না পাওয়া আর মূলধনের ঘাটতির কারণকেই দায়ী করেনই তার এ দশার জন্য।
'নিজের জমি না থাকায় কোনো ব্যাংক থেকেই ঋণ পাচ্ছি না, ফলে হাড়ও কিনতে পারছি না,' বলেন তিনি।
হাজারীবাগ এলাকায় হাড্ডি পট্টির এ দুর্দশার কারণে প্রতি বছর অনেক হাড় নষ্ট হচ্ছে বলে ধারণা করেন ভোলা মিয়াসহ এ এলাকার অন্যান্য ব্যাবসায়ীদের।
হাজারীবাগের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি কেজি কাঁচা হাড় ১৮-১৯ টাকা আর শুকনো হাড় ২১-২২ টাকায় বিক্রি হয়।
কিন্তু হাড় পরিষ্কারের জন্য ব্লিচিং পাউডারসহ অন্যান্য কেমিক্যালের দাম, গাড়ি ভাড়া, কর্মীসহ অন্যান্য খরচ বাড়লেও হাড়ের দাম তেমন বাড়েনি ফলে ব্যবসায় মুনাফা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
প্রতি বছর দেশে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি গরু, মহিষ, ভেড়া জবাই হয়। ফলে প্রতি বছর এখান থেকে বেশ বড় পরিমাণে হাড়, নাড়িভুঁড়িসহ গবাদি পশুর অন্যান্য উচ্ছিষ্ট পাওয়া যায়।
এ খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, কোরবানি ও সারা বছর ধরে জবাইকৃত গরু বা মহিষের উচ্ছিষ্টের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই মূল্যবান উচ্ছিষ্টের বড় একটি অংশ নষ্ট হচ্ছে।
হাড় ও অন্যান্য উচ্ছিষ্ট অংশ যা বিভিন্ন কাজে লাগতে পারে, তা যথাযথভাবে সংগ্রহ না হওয়ায় ময়লার ভাগাড়ে নষ্ট হচ্ছে। ফলে গ্লোবাল ক্যাপসুলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর হাড়ের গুঁড়া আমদানিতে আনুমানিক ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়।
গরুর হাড়ের আরেকটি বড় ব্যবহার হয় পশুখাদ্যে। দেশের পোলট্রি ও মৎস্য শিল্পের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে দিন দিন বাড়ছে মিট অ্যান্ড বোন মিলের (এমবিএম) চাহিদা, যা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
দেশে যথাযথভাবে হাড় প্রক্রিয়াজাত করা গেলে প্রতি বছর বড় অঙ্কের আমদানি খরচ বাঁচানো যেত। জবাইয়ের আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে জবাইকৃত পশুর উচ্ছিষ্টাংশ থেকে নিজেরাই এমবিএম তৈরি করা গেলে অনেক বড় একটি আমদানি খরচ বেঁচে যেত প্রতি বছর।