খাদ্য হিসেবে ‘ব্যাঙের পা’ কেন ইউরোপীয়দের এত প্রিয়?
ব্যাঙের পা নিয়ে ইউরোপীয়দের চাহিদা দীর্ঘদিন ধরেই প্রাণীটিকে বিপন্ন করে তুলেছে, প্রথমে খোদ ইউরোপে এবং এরপর পুরো বিশ্বেই, এরকম তথ্য উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
১৯৮০-এর দশক থেকেই ইউরোপের বন-বাদাড় থেকে এত বেশি পরিমাণে ব্যাঙ ধরা শুরু হয় যে, ইউরোপের অভ্যন্তরে ব্যাঙ বেচা-কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে এরপর আইন অনুযায়ী, অন্যান্য দেশ থেকে ব্যাঙ আমদানি শুরু হয়।
সারা বিশ্বে ব্যাঙের অবস্থা কী, তাদের জনসংখ্যা কেমন বা এই বাণিজ্যের ফলে ব্যাঙের সংখ্যার ওপর কী প্রভাব ফেলেছে তা এতদিন ধরে জানা না গেলেও গত মাসে ন্যাচারে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণাটি থেকে জানা যায়, প্রতিবছর পায়ের জন্য লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ ধরা হয়। এবং এর ফলে ব্যাঙের বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ব্যাঙ, যারা পোকামাকড় খেয়ে, অন্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে, গর্ত করে মাটিতে বাতাস প্রবাহিত করে এবং ট্যাডপোল হিসেবে পানি পরিষ্কার করে পরিবেশে ভারসাম্য রাখে।
জার্মান পরিবেশ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান প্রো-ওয়াইল্ডলাইফের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং নিবন্ধটির সহ-লেখক সান্দ্রা আলথার জানান, "পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মারণাত্মক কাইট্রিড ফাঙ্গাসের কারণে উভচর প্রাণীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর ওপর, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্যাঙের পায়ের চাহিসার জন্য সারাবিশ্বে বুনো ব্যাঙ-এর পরিমাণ একেবারেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।"
আলথার আর তার সহযোগীরা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাঙের পায়ের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক হলেও এই বাণিজ্য টেকসই করার জন্য কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের তদারকি করা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গ্লোবার এনভায়রনমেন্টাল কোঅপারেশন অ্যান্ড মাল্টিল্যাটারেলিজমের প্রধান হর্গে রদ্রিগেজ রোমেরোর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো প্রত্যুত্তর দেননি তিনি।
জার্মানির বনে অবস্থিত লাইবনিজ ইনিস্টিউট ফর দ্য অ্যানালাইসিস অফ বায়োডাইভার্সিটি চেঞ্জের হার্পিটোলজিস্ট (উভচর ও সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ) মার্ক আউলিয়া জানান, ব্যাঙের পা বাণিজ্যের কোনো কিছুই স্বচ্ছ নয়। আমদানিকৃত ব্যাঙের পায়ের ওজন ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর কোনো উপাত্তই সংগ্রহ করে না।
এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয়, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৮৯.৭ মিলিয়ন পাউন্ড সমান ব্যাঙের পা আমদানি করেছে, যা ৮১৪ মিলিয়ন থেকে ২ বিলিয়ন ব্যাঙের প্রাণনাশের জন্য দায়ী! দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম সবচেয়ে বেশি ব্যাঙের পা আমদানি করেছে।
ব্যাঙের পা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেজ, গবেষণা প্রবন্ধ, সংবাদ প্রতিবেদন এবং বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষণ অবস্থা বিষয়ক সবচেয়ে বিস্তারিত ডেটাবেজ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনভার্সেশনের রেড লিস্টের শরণাপন্ন হয়েছে দলটি।
বিশ্বব্যাপী ব্যাঙের ১৯০টি প্রজাতির বাণিজ্য করা হলেও ধারণা করা হয় এটি আরও বেশি হবে। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় ফ্রান্সের দোকানে বিক্রি করা ব্যাঙগুলোর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যে ২০৯টি ব্যাঙকে জাভান জায়ান্ট ফ্রগ হিসেবে লেবেলকৃত করা হয়েছিল, তার ২০৬টিই অন্য প্রজাতির ব্যাঙ।
যে প্রজাতিগুলোকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তারমধ্যে ৫৮টি প্রজাতিকে আইইউসিএন বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, আরও ১০টি প্রজাতি রয়েছে মারাত্মকভাবে বিপন্নের তালিকায়। তবে এই সংখ্যা খুবই কম বলে দেখানো বলে মনে করেন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজার্ভেশন বায়োলজিস্ট অ্যালিস হিউজেস। তার মতে, বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে যে ব্যাঙগুলোকে ব্যবহার করা হয় সে সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না, একইসাথে কোন প্রজাতির কী পরিমাণ পা আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে, সেটিরও কোনো বিস্তারিত হিসাব নেই।
ব্যাঙের পায়ের এই বাণিজ্য ব্যাঙের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যেমন: ইন্দোনেশিয়ার বড় পায়ের প্রজাতি ব্লাইথ'স জায়ান্ট ফ্রগ এবং মালেশিয়ান ফ্রগের পরিমাণ এতটাই কমে গিয়েছে যে দেশটি ছোট আকারের কাঁকড়াভুক ব্যাঙ রপ্তানি শুরু করেছে। আলবেনিয়ায় ওয়াটার ফ্রগ অতিরিক্ত ধরার ফলে এই বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ব্যাঙের প্রজাতি প্রকৃতি থেকে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ তুরস্ক থেকে আনাতোলিয়ান ফ্রগ ধরার ফলে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে এর পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ গতিতে চলতে থাকলে ২০৩২ সালের মধ্যেই প্রজাতিটি বিলুপ্তি হয়ে যাবে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
হিউজেস জানান, "সাধারণ মানুষ আইনি বাণিজ্য এবং টেকসই বাণিজ্যের মধ্যে ওলোটপালোট করে ফেলে। রপ্তানি করা দেশগুলো যদি এই প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ না নেয়, টেকসই বাণিজ্যের দিকে না ঝোঁকে, তবে খুব শীঘ্রই বাকি প্রজাতিগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।"
কেবল প্রজাতির পরিমাণই কমে যাচ্ছে, এটিই একমাত্র বিষয় নয়। প্রায়ই ব্যাঙগুলোকে জ্যান্ত অবস্থাতেই পা আলাদা করে সেগুলোকে আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আলথার বলেন, "যারা সবাই এই সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পেতে চান, তাদের এই স্বাদের পেছনের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কেও জানা উচিৎ।"
"ইউরোপের দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ"
বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের ফলে কোনো প্রজাতি যেন বিলুপ্ত না হয়ে যায় সেজন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সাইটসের তালিকায় মাত্র দুটি প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। ১৯৮৫ সালে সাইটস ইউরোপে ইউফ্লিকটিস হেক্সাড্যাক্টিলাস এবং হোপ্লোব্যাক্ট্রাকাস টাইগেরিনাস নামের দুইটি প্রজাতি রপ্তানির হিড়িক পড়লে ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে এই দুই প্রজাতির ব্যাঙের জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় সাইটস।
আউলিয়া বলেন, "এরপর থেকে বাকি প্রজাতিগুলো সংরক্ষণের জন্য আর কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।"
জোনাথন কলবি নামের আরেকজন হার্পিটলজিস্ট জানান, "ব্যাঙ সংরক্ষণ করার জন্য আইনের এই অভাব আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ জন্ম দিতে পারে এবং সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধা দিতে পারে। গবেষকরা গবেষণা করে যা বের করেছেন, প্রকৃত অবস্থা হয়তো এর চেয়েও খারাপ।"
ব্যাঙের পা বাণিজ্যকে টেকসই ও স্বচ্ছ করার জন্য বেশ কিছু সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে ন্যাচারের এই গবেষণা প্রবন্ধটি।
ব্যাঙের কী পরিমাণ বাণিজ্য করা হচ্ছে, কী ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রজাতিগুলোকে, তার বিস্তারিত উপাত্ত সংগ্রহসহ অন্যান্য রেকর্ড দেখাশোনা এবং কেন্দ্রীকরণ করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যাঙের শরীরে রয়েছে তা পরীক্ষা করা এবং ব্যাঙ ধরার সময় সেগুলোর ওপর অমানবিক কাজ যাতে না করা হয় তা দেখাশোনাও করতে পারে তারা। এছাড়াও ব্যাঙের পা সংগ্রহ করার আগেই সেগুলোকে পরিবহণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের আগে কী পরিমাণ ব্যাঙ মারা যায়, তার উপাত্তও সংগ্রহ করতে পারে ইইউ। এর কোনোটিই বর্তমানে করা হয় না।
হিউজেস জানান, "এগুলো ছাড়াও সাইটসের তালিকায় অন্যান্য ব্যাঙের প্রজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায়িত্ব। এই চাহিদা মেটানোর বিপরীতে আমাদেরকে এগুলো রক্ষা করার দায়িত্বও নিতে হবে। বন থেকে কী পরিমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে তার কোনো উপাত্ত না রেখেই একাধারে হাজারে হাজারে ব্যাঙের বাণিজ্য করা খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ।"
প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির ব্যাঙ বিশেষজ্ঞ অ্যান মেরি ওহলার জানান, "ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। যে দেশগুলো আর্থিক কারণে ব্যাঙ রপ্তানি করছে তাদের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলো। কিন্তু বাস্তবে, ইউরোপীয় দেশগুলোকেই দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ।"
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক