টানা পাঁচবার ড্রোন ফটো অ্যাওয়ার্ডসপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী তানভীরের গল্প
'এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ!' পাখির চোখে আমাদের পরিচিত চারপাশ ধরা পড়ে নতুন আঙ্গিকে। খুব চেনা কোনো দৃশ্য, যা হয়তো খেয়াল করে দেখার ফুরসত মেলেনি কখনো, তাও অপূর্ব হয়ে উঠতে পারে সেই চোখ থেকে। পাখির চোখে ভর করে মানুষের এই অপূর্ব সৌন্দর্য দেখার অন্যতম উপায় ড্রোন ফটোগ্রাফি। বিশ্বেজুড়ে ড্রোন ফটোগ্রাফির জনপ্রিয়তা বাড়ছে দিনদিন।
সারাবিশ্বে ড্রোন ফটোগ্রাফির জন্য অন্যতম মর্যাদাজনক পুরস্কার ইতালির সিয়েনা অ্যাওয়ার্ডস আয়োজিত 'ড্রোন ফটো অ্যাওয়ার্ডস'। টানা পাঁচ বছর ধরে এই অ্যাওয়ার্ডে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মোঃ তানভীর হাসান রোহানের তোলা বেশ কিছু ছবি। এবছরের ড্রোন ফটো অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ছবিগুলোর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে জুনের ২৬ তারিখ। তানভীর হাসান ছাড়াও বাংলাদেশের ছয়জন আলোকচিত্রীর তোলা ছবি ও ফটো সিরিজ জায়গা পেয়েছে সেই তালিকায়।
শখের আলোকচিত্রী তানভীর হাসানের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা এক দশকের বেশি সময়ের। ক্যামেরার লেন্সে মানুষের কাজের জগত দেখতে ভালোবাসেন তিনি। সে জগত যখন ড্রোনের সাহায্যে কয়েকশো মিটার উপর থেকে দেখতে পান তখন বদলে যায় পুরো দৃশ্যই। পেশাদার আলোকচিত্রী না হলেও ছবি তোলা তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ জীবনের এক কঠিন সময়ে তাকে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এই ফটোগ্রাফি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে স্থায়ী হলেও ছবির প্রিয় ফ্রেম খুঁজে পেতে বারবার দেশে ফিরে আসেন তিনি।
দুর্ঘটনা থেকে শুরু
২০১০ সালে এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য শয্যাশায়ী হতে হয় তানভীর হাসান রোহানকে। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি ভালোবাসা ছিল তার। অসুস্থ শয্যায় অলস সময় কাটাতে কাটাতে যখন অস্থির হয়ে ওঠেন তখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেই ফটোগ্রাফির ভূত।
মায়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ক্যামেরা দিয়ে বিছানা থেকেই জানালার বাইরের প্রকৃতির ছবি তুলতে শুরু করেন তানভীর। সে সময়টায় তাকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে বেশ সাহায্য করেছিল এই ফটোগ্রাফির ঝোঁক। সুস্থ হওয়ার পর ধীরে ধীরে আগ্রহ জন্মায় লাইফস্টাইল ফটোগ্রাফির প্রতি। নিজের ব্যবসার ফাঁকে সুযোগ মিললেই পরিচিত এক ছোটভাইকে নিয়ে ছবি তোলার উদ্দেশ্যে ছুটতেন দেশের নানা প্রান্তে।
পরিবেশ দূষণসহ সামাজিক নানান সমস্যা তার তোলা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন তানভীর। শুরুতে বিভিন্ন বই পড়েই ফটোগ্রাফির খুঁটিনাটি শেখার চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ফটোগ্রাফিক গ্রুপ থেকেও পেতেন সাহায্য। ২০১৪ সালে আলোকচিত্রী রফিকুল ইসলামের কাছে ফটোগ্রাফি কোর্স করেন তিনি। এরপর থেকেই ছবি তোলাকে 'প্যাশন' হিসেবে নেন তানভীর হাসান রোহান।
ড্রোনে ছবি তুলতে মাথায় রাখতে হয় যেসব
২০১৬ সালের দিকে প্রথম ড্রোনের সাহায্যে ছবি তোলা শুরু করেছিলেন তানভীর। তখন ড্রোন ফটোগ্রাফির ছবির কোয়ালিটি খুব একটা ভালো ছিল না। ২০১৮ সালে নিজের ড্রোন কেনার পর থেকে মানসম্পন্ন ছবি তুলতে মনোযোগী হন তিনি।
যেহেতু সব এলাকায় ড্রোন পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়া যায় না, তাই শুরুতেই বিমান বাহিনীতে থাকা এক পরিচিতজনের কাছ থেকে নিয়মকানুন জেনে নেন তানভীর। 'আমেরিকায় মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেই বিমানের গতিপথ জানা যায়। সে অনুযায়ী সাবধানে থেকে ড্রোন চালানো যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সুবিধা নেই। তাই নিজে থেকেই অনেক ভেবেচিন্তে জায়গা নির্ধারণ করতে হয়৷ তবে ড্রোনে ছবি তোলার জন্য খুব বেশি উপরে তুলতে হয় না একে। ১০০ মিটার উচুঁ থেকেই ভালো ছবি তোলা যায়,' বলেন তানভীর হাসান রোহান।
ড্রোনে ছবি তুলতে হলে শুরুতেই এর রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হবে বলে জানান তানভীর। তা না হলে জনবহুল এলাকায় ড্রোন চালিয়ে ছবি তুলতে গেলে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ড্রোনের ব্যাটারি ঠিক আছে কি না তা খেয়াল রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। উড়ন্ত ড্রোনে ব্যাটারি নষ্ট হলে আগুন লেগে যেকোনো জায়গায় পড়তে পারে।
ড্রোন কতটা বাতাস সহনশীল তা মাথায় রাখতে হবে আগেই। খুব বেশি বাতাসের জায়গায় ড্রোন চালাতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে।
কোনো এলাকায় ড্রোন পরিচালনা করার আগে সেখানকার স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া জরুরী বলে জানান তানভীর। নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় ড্রোন উড়ানো নিষিদ্ধ হলে তারাই নির্দেশনা দিয়ে দেন।
'কয়েক বছর আগে গ্রামঞ্চলে ড্রোন দিয়ে ছবি তুলতে গেলে মানুষ ভয় পেয়ে যেত। অনেকে তেড়েও আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এই যন্ত্রটির সাথে। তাছাড়া আমি যেখানকার ছবি তুলি সেখানে কর্মরত মানুষদের আগেই বুঝিয়ে নিই। তা না হলে কাজ ফেলে অধিকাংশ মানুষ ড্রোনের দিকেই তাকিয়ে থাকে,' ড্রোনে ছবি তোলার বিপত্তি নিয়ে জানান তানভীর।
তবে তানভীরের মতে, ড্রোন অনেকসময় ফটোগ্রাফারদের অলস বানিয়ে দেয়। অনেকেই কষ্ট করে দুর্গম জায়গায় যাওয়ার বদলে ড্রোনের সাহায্য নিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এতে ফটোগ্রাফির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন তারা। যেসব জায়গায় আসলেই ড্রোনের সাহায্য ছাড়া ছবি তোলা সম্ভব না, বা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না, সেসব জায়গাতেই ড্রোন ব্যবহার করে ফটোগ্রাফি করতে পছন্দ করেন তানভীর হাসান রোহান।
অ্যাওয়ার্ডজয়ী ছবির নেপথ্যে
এ বছর আন্তর্জাতিক ড্রোন ফটো অ্যাওয়ার্ডে প্রশংসিত হয়েছে তানভীর হাসান রোহানের তোলা দুটি ছবি। যার মধ্যে একটি ২০২৩ সালের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিনে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়েতে জুম্মার নামাজের ছবি। আরেকটি ছবি ২০২১ সালের বগুড়ার ধানের চাতালের।
বিশ্ব ইজতেমায় জুম্মার নামাজে হাইওয়ের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের সারিবদ্ধ জামাতের ছবিটি তানভীর তুলেছিলেন এক হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে ড্রোন চালিয়ে।
দুই বছর আগের শীতে ড্রোন দিয়ে বগুড়ার ধানের চাতালের ছবি তুলে মুগ্ধ হয়েছিলেন তানভীর হাসান। কয়েকশ মিটার উপর থেকে আমাদের চেনা ধানক্ষেতের দৃশ্য বদলে যায় পুরোটাই। হলুদ রঙের শামিয়ানার মতো সেই ধানের চাতালের ছবিটিও প্রশংসিত হয়েছে ড্রোন ফটো অ্যাওয়ার্ডে।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন ৭০০'র বেশি
প্রায় ১০ বছরের ছবি তোলার অভিজ্ঞতায় জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য অর্জনের পাশাপাশি এ পর্যন্ত ৭০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তানভীর হাসান রোহান। প্রতিনিয়তই নিজের তোলা ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার ভাষ্যে, 'শুরুতে যখন ফটোগ্রাফির খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিল না তখন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছি৷ ধীরে ধীরে নিজের চেষ্টাতেই ছবির মান উন্নত করার চেষ্টা করেছি। কোনো কিছুর প্রতি প্যাশনেট হয়ে লেগে থাকলে তার ফল মিলবেই।'
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি এ পর্যন্ত তানভীর হাসানের তোলা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে ৪৫টিরও বেশি দেশে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে টানা দুইবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেল ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার রেকর্ডও তার। এছাড়াও গ্রিস, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, চেক প্রজাতন্ত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফআইএপি'র পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় পাঁচবার 'বেস্ট অথর' হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তানভীর। সম্প্রতি নিউইয়র্ক ইন্সটিটিউট অব ফটোগ্রাফি থেকে ফটো জার্নালিজমের উপর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
নিজের কাজের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ছবি তোলায় আগ্রহী করে তুলতে চান তানভীর। তার ভাষ্যে, 'তরুণেরা যেন বাজে নেশায় না জড়িয়ে ছবি তোলার মতো কাজে অবসর ব্যয় করে তার জন্য দিকনির্দেশনা দরকার। নতুন যারা ফটোগ্রাফিতে আসতে চায় তাদের সাহায্য করতে চাই আমি। ফটোগ্রাফি বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করারও ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে।'