গৃহস্থালি কাজে রোবট আসতে আর কতদিন!
আপনার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পণ্যের বাজার কোনটি? আপনি কি মোবাইল ফোনের কথা ভাবছেন? গাড়ি? বা প্রপার্টি বাজার?
এই সবগুলো বাজারেই প্রচুর ক্রেতা-বিক্রেতা রয়েছে ঠিকই; কিন্তু স্যাংচুয়ারি এআই-এর প্রধান কার্যনির্বাহী জর্ডি রোজ মনে করেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এমন একটি নতুন পণ্য বাজারে আসবে যা এই জায়ান্টদেরও পেছনে ফেলবে।
ভ্যাঙ্কুয়েভার-ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি 'ফিনিক্স' নামক এমন একটি হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করছে যেটি বুঝতে পারবে মানুষ কী চায়, কিভাবে বিশ্বে প্রতিনিয়ত নানা কাজ সম্পাদন হচ্ছে এবং রোবটটির মধ্যে মানুষের সকল নির্দেশ মেনে কাজ করার মতো দক্ষতা থাকবে।
রোজ বলেন, "দীর্ঘমেয়াদে কোনো পণ্য বা পরিষেবার জন্য কত বড় বাজার তৈরি হবে সেটিই ব্যবসা ও প্রযুক্তির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজার- আর তা হলো শ্রম বাজার। আমরা যা কিছু চাই তা এখানেই পাওয়া যায়।"
কিন্তু তড়িঘড়ি করে এখনই নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর আগে রোজ বলে রাখতে চান, "এই মুহুর্তে আমরা যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।"
ঠিক কবে নাগাদ আমরা কোনো রোবটকে ঘরের কাজ, যেমন- লন্ড্রি বা বাথরুম পরিষ্কার করার মতো কাজে নিযুক্ত হতে দেখবো, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে রাজি নন রোজ। কিন্তু এ খাতে সংশ্লিষ্ট অন্য যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের ভাষ্যমতে, আগামী দশ বছরের মধ্যেই হয়তো সেই দৃশ্য আমরা দেখতে পাবো।
এই মুহূর্তে বিশ্বের আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। যুক্তরাজ্যে গৃহস্থালি কাজকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে এআই এবং রোবটিকস খাতে বিনিয়োগ করছে ডাইসন।
তবে খুব সম্ভবত এই খাতে বর্তমান বাজারে সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল যে কোম্পানিটি কাজ করছে তা হলো ইলন মাস্কের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা। এই মুহূর্তে টেসলা তাদের অপটিমাস হিউম্যানয়েড রোবট নিয়ে কাজ করছে এবং মাস্ক জানিয়েছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এটি বিক্রির জন্য বাজারে আনা হতে পারে।
মাস্কের এই বক্তব্য বাস্তবে পরিণত হয় কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই মুহূর্তে আমরা যা বলতে পারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে হিউম্যানয়েড রোবটের বিকাশের সম্ভাবনা ত্বরাণ্বিত হচ্ছে।
"প্রযুক্তি এখন যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দশ বছর সময়কে এখন অনন্তকাল বলে মনে হবে। সবাই দেখতে পাচ্ছে, প্রতিদিনই এআই জগতে নতুন কিছুর উদ্ভাবন হচ্ছে, নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে যেগুলো প্রায় মৌলিক পরিবর্তনের মতো", বলেন রোজ। জর্ডি রোজ নিজে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এর আগে তিনি একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
গত বছরের শেষের দিকে ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি নামক এআই চ্যাটবট লঞ্চ হওয়ার পর থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে। ওপেনএআই বলেছে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক নামক একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
এটি কথোপোকথন শুরু, প্রশ্নের উত্তর প্রদান, ভুল স্বীকার, ভুল অনুমান চ্যালেঞ্জ এবং অযাচিত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম। রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক্স লেখা, গল্প লেখা, এমনকি কবিতা লিখতেও নির্দেশ দেওয়া যাবে এই চ্যাটবটকে। চ্যাটজিপিটির ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোও আটঘাঁট বেধে এআই খাতে বিনিয়োগে নেমেছে।
কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্য রোবট নির্মাণের মতো এআই প্রযুক্তি নিয়ে আসা খুবই কঠিন একটি কাজ।
চ্যাটজিপিটি এবং এর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এই প্রযুক্তির পার্থক্য হলো, এখানে হিউম্যানয়েড রোবটকে সরাসরি বাস্তব দুনিয়ায় কাজ করে দেখাতে হবে এবং বাস্তবে একটি বস্তুর সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক কী তা বুঝতে হবে।
এক্ষেত্রে, মানুষের কাছে যেসব কাজ খুবই সহজ, সেগুলো করতে পারাই হিউম্যানয়েড রোবটের জন্য সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
উদাহরণস্বরূপ, একটি ট্রায়াল প্রকল্পের অংশ হিসেবে স্যাংচুয়ারি'র রোবট ফিনিক্সকে কানাডার একটি দোকানের ব্যাকরুমে প্লাস্টিকের ব্যাগে কাপড় প্যাকিং করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
"এআই পরিচালিত রোবটিকস সিস্টেমে এটা একটা সমস্যা যেখান থেকে আরও জটিল কিছু সমস্যা উঠে আসে; কারণ ব্যাগগুলো বেশ বড়সড়, ঝোলা এবং স্বচ্ছ ধরনের... আর এগুলো খোলার মুখ একটাই। সাধারণত আপনি যখন এসব ব্যাগ খুলতে যাবেন, এক হাতে ব্যাগের মুখ খুলে অন্য হাতে কোনোকিছু এর ভেতরে রাখতে হবে। রোবটের জন্য হাত দিয়ে ধরে এসব ব্যাগ নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন", এজন্যেই বর্তমানের হিউম্যানয়েড রোবটগুলো হলিউডের সিনেমায় দেখানো রোবটের মতো অতটা ভয়ঙ্কর নয়, বলেন জর্ডি রোজ।
ব্যাগ প্যাকিংয়ের মতো কাজগুলো সম্পাদনের জন্য ফিনিক্স রোবটকে প্রশিক্ষণ দিতে একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে স্যাংচুয়ারির। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে তারা তাদের রোবটকে দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কাজ করার ভিডিও ধারণ করবে এবং তারপর পুরো ইভেন্টটাকে ডিজিটালাইজ করবে।
সেই ডেটা এবং অন্যান্য বস্তু ব্যবহার করে তারা একটি ভার্চুয়াল পরিবেশ তৈরি করবে যা মাধ্যাকর্ষণ ও রেজিসট্যান্সসহ পদার্থবিদ্যার বিষয়গুলোকে সিমুলেট করবে।
এরপরে এআই সেই ভার্চুয়াল পরিবেশে নির্দিষ্ট কাজটি সম্পাদনের জন্য অনুশীলন করবে। এটি চাইলে তখন লাখ লাখ বার চেষ্টা করতে পারবে এবং যখন নির্মাতাদের মনে হবে এআই ভার্চুয়াল পরিবেশে ওই কাজটি সম্পাদনের দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে, তখন এটিকে বাস্তব পরিবেশে কাজ করতে দেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় ফিনিক্সকে প্রায় ২০টি আলাদা আলাদা কাজ সম্পাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
সবচেয়ে বড় একটা চ্যালেঞ্জ হলো রোবটকে স্পর্শের অনুভূতি দেওয়া, যাতে করে এটি বুঝতে পারে যে কোন বস্তুর ওপর কতখানি চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
"আমাদের এই কাজগুলো করার দক্ষতা আছে যা বিবর্তনের ফলাফল...কয়েকশো কোটি বছর ধরে চলে আসছে; কিন্তু মেশিনের জন্য এই কাজগুলো খুবই কঠিন", বলেন রোজ।
বাড়িতে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যস্ত কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যেসব কাজ করতে হয় তাতে অভ্যস্ত হওয়ার মতো রোবট বানাতে এখনও অনেক কাজ বাকি।
"আপনি রোবটকে একটা অসংগঠিত পরিবেশে রাখতে পারবেন না; তেমন পরিবেশে রাখলে এটি নিজের কাজ করতে গিয়ে আশেপাশের জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলবে। এইমুহূর্তে প্রযুক্তির কাছে এতখানি আবদার করা সম্ভব না", বলেন অধ্যাপক আলিরেজা মোহাম্মাদি। অধ্যাপক আলিরেজা ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান-ডিয়ারবর্ন-এ রোবটিক মোশন ইন্টেলিজেন্স ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি বলেন, আপনি চাইলে এআইকে ভার্চুয়ালি লাখ লাখ ধরনের আলাদা আলাদা পরিবেশে প্রশিক্ষণ দেওয়াতে পারেন; কিন্তু তারপরেও এমন হতেই পারে যে বাস্তবে এটি এমন কিছুর মুখোমুখি হলো যা আগে কোনোদিন দেখেনি। এমতাবস্থায় এটি বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে।
তার ভাষ্যে এ সমস্যার একটা দিক হলো- কোনো একটি পরিবেশ ও সেখানে কাজের ফলাফল সম্পর্কে মানুষের আগে থেকেই ধারণা করতে পারার ক্ষমতা আছে। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ বুঝতে পারে যে একটা পাগলা কুকুর মানুষের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লে এর দ্বারা কি ক্ষতি হতে পারে এবং মানুষ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু রোবটের মধ্যে সেই ক্ষমতা তৈরি করা খুবই কঠিন।
"আগামী দশ বছরের মধ্যে আমাদের হয়তো তেমন রোবট থাকবে যেগুলো মানুষের নির্দেশনা মোতাবেক চলাফেরা ও কিছু কাজ করতে পারবে, কিন্তু একটা অসংগঠিত পরিবেশে তা সম্ভব না", বলে অধ্যাপক আলিরেজা।
কিন্তু এই চ্যালেঞ্জগুলো যদি জয় করা সম্ভব হয়, তাহলে বর্তমানে মানুষ যেসব কাজে নিয়োজিত আছে, ভবিষ্যতে হিউম্যানয়েড রোবটই কি সেই জায়গা দখল করবে?
রোজ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কর্মী সংকট রয়েছে এবং সেখানে হয়তো রোবটেরা সেই ঘাটতি দূর করতে পারবে।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা এবং হেরিয়ট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত ন্যাশনাল রোবটারিয়াম মূলত এআই এবং রোবটিকস নিয়ে কাজ করে। এটির প্রধান কার্যনির্বাহী স্টুয়ার্ট মিলার বলেন, "অবশ্যই একটা পর্যায়ে গিয়ে অতীতে যেসব কাজ মানুষ করতো, সেগুলো রোবটের দ্বারা সম্পাদিত হবে... কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর দ্বারা আসলে কি বুঝায়?"
"শুরুর দিকে আমরা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হবো। কিন্তু যখন এ বিষয়ে ভাবছি, আমাদের মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতে হবে এই নিয়ে যে কোন কাজগুলো মানুষ সবচেয়ে ভালো করে? মানুষকে ওইসব কাজের জন্যই সময় বরাদ্দ রাখতে হবে, মেশিন যে কাজগুলো সবচেয়ে ভালো করবে সেগুলোর জন্য নয়", বলেন মিলার।