অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ৫৪ মার্কেট ও বস্তি
চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় বাজার, রেয়াজুদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিাবার (১২ জানুয়ারি)। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছে বাজারটি।
এর আগে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাজারের হোটেল সফিনায় ও ২০২০ সালে ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার বৃহত্তর এই রেয়াজুদ্দিন বাজারের নাম রয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের তালিকায়।
এরপরও যেন হুঁশ নেই কারও। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই একটির সাথে আরেকটি ঘেঁষে নির্মাণ হচ্ছে নতুন ভবন। সেই আগের মতোই এখনো অপ্রশস্ত সড়ক; নেই অগ্নি নির্বাপনের কোনো ব্যবস্থা।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও খাতুনগঞ্জসহ অন্তত ৪২টি মার্কেট এবং শহরের ১২টি বস্তি আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের উপসহকারী পরিচালক নিউটন দাশ বলেন, "এই ৫৪টি মার্কেট ও বস্তির বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষ করে রেয়াজুদ্দিন বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ এখানে একটি মার্কেটের সাথে আরেকটি মার্কেটে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। দুইশো মার্কেটই মনে হয় এক ছাদের নিচে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একসাথে কাজ না করলে এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড থেকে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।"
"এছাড়া তালিকায় থাকা অধিকাংশ মার্কেটের গলি সরু। পানিও পাওয়া যায় না। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানোও কঠিন। আমরা ব্যবসায়ীদের প্রায় সময়ই সচেতন করি। কিন্তু সচেতন হন না। কেউ হাজার টাকা দিয়ে একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও কেনেন না। অথচ পরে হারান লাখ টাকার জিনিস," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৭ হাজারের মতো বহুতল ভবন আছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভবন আবাসিক এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক— উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভবনগুলোই সবচেয়ে বেশি আগুনের ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, "বহুতল ভবনের অনুমতি দেয় সিডিএ। ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা জরিপ করে দেখেছি, ভবনের কাজ শুরুর আগে আমাদের কাছ থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়ার যে বিধান আছে, ৯৩ শতাংশ ভবনের সেই অনাপত্তি পত্র নেই।"
"ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান আছে। ৯৭ শতাংশ ভবনের সেই ছাড়পত্রও নেই। ৯৭ শতাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থাই নেই," যোগ করেন জসিম উদ্দিন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত বছর চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলোর কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিতে শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। যেসব ভবনে এরই মধ্যে বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেগুলোকে প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুসরণ করে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, "চট্টগ্রামে প্রায় তিন লাখ ভবন আছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ হাজার বহুতল ভবন। গত পাঁচ বছরে যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, সেগুলোতে কিছুটা অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানা হয়েছে। কিন্তু ১০ থেকে ১২ বছর আগে যেসব বহুতল ভবন বানানো হয়েছে, সেগুলো অগ্নি নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা করেনি। ফলে চট্টগ্রামে বিশাল এক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।"
"যেকোনো মুহূর্তে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতে এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে," উল্লেখ করেন তিনি।
অগ্নিকাণ্ডে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের তালিকায় অগ্নিকাণ্ডের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় দুইশো মার্কেটের রিয়াজউদ্দিন বাজার। এই বাজারে ১০ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে।
অগ্নিঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য মার্কেটগুলো হচ্ছে- খাতুনগঞ্জ, জহুর মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমণ্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরু মিয়া মার্কেট, নূপুর মার্কেট, ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড় পুল বাজার, ইসা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্লাতলি বাজার।
এছাড়া ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের অধীন চৌধুরী মার্কেট, কলসি দিঘির পাড় কলোনি, আকমল আলী কলোনি, মহাজন টাওয়ার, রেলওয়ে বস্তি, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গুলজার মার্কেট, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার, শাহেন শাহ মার্কেট, হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সুপার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট এবং বলির হাট মার্কেটও রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিঝুঁকির তালিকায়।
এর পাশাপাশি এই তালিকায় আরও রয়েছে- লামার বাজার স্টেশনের অধীন ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরোনো জুট মার্কেট ও ওমর আলী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন এলাকার রেলওয়ে বস্তি, বার্মা কলোনি, ২ নম্বর গেট ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনি, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপ্লেক্স এবং চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স।