অবৈধ বিলবোর্ডে ফের ছেয়ে যাচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্যে গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। কবি শঙ্খ ঘোষের 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে' শীর্ষক কবিতার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। একটু আগ বাড়িয়ে আমরা যদি 'বিলবোর্ড' শব্দটি ব্যবহার করি তবেই যেন কবিতা স্বার্থকতা পায়।
একসময় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছেয়ে গিয়েছিল রকমারি বিলবোর্ড, ইউনিপোল আর মিনিপোলে। আড়ালে চলে গিয়েছিলে পাহাড়, সবুজ গাছপালা ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চট্টগ্রাম। অবস্থা এমন ছিলো বিখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ তো কোন ছাড়, নগণ্য পথচারীকে খুঁজে পাওয়াও ছিলো ভার! বিলবোর্ড মাথায় পড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিলো অনেকবার। বছর তিনেক আগে চসিক সেসব উচ্ছেদ করলেও একটু একটু করে শহরে আবার ফেরত আসছে বিলবোর্ডের সেই 'অত্যাচার'।
চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক মোড়ে প্রয়াত সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে স্থাপিত রূপালী গিটার ভাস্কর্যের সামনে ও আশপাশে গত শনিবার একটি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ড বসানো হয়। গিটারের সামনে বিলবোর্ড লাগানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পরে চট্টগ্রামের মানুষ।
রাতেই নগরবাসী জড়ো হয়ে সাইনবোর্ডগুলো ভেঙে ফেলে। তবে ওই সাইনবোর্ড অপসারণ হলেও চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার, জিইসি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে বসছে সাইনবোর্ডের পসরা। নগরের মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের প্রতিটি পিলারের দুই পাশে শোভা পাচ্ছে ফ্রেশ গুঁড়ো দুধ, ইউনি গ্যাস, গাজী টায়ার, সেভেন রিং সিমেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন। গাড়ি চালকরা অভিযোগ করেছেন এসব ডিজিটাল সাইনবোর্ডের আলোর কারণে রাতের বেলা তাদের গাড়ি চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়; অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
নগরের নুর আহমদ সড়কের পুরো সড়কদ্বীপ জুড়েই লাগানো হয়েছে এক্স সিরামিক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল বিলবোর্ড। যাতে ঢাকা পড়েছে নগরের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় তৈরী স্থাপনা ও গাছগাছালি। কাজীর দেউড়ি থেকে ওয়াসা মোড় পর্যন্ত সড়কদ্বীপে শোভা পাচ্ছে রাজস্থান নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন।
চকবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্যারেড কর্ণার এলাকায় একটি যাত্রী ছাউনিতে 'ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য' এমন নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে নোটিশ ঝুলছে নগরের ষোলশহর, আগ্রাবাদ ও কর্ণেলহাট এলাকায়।
নোটিশে থাকা নম্বরের সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হলে সুমন নামে এক ব্যক্তি জানান তারা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নিয়েই বিলবোর্ড স্থাপন করেছেন। যাত্রী ছাউনির উপরের অংশের জন্য মাসে গুনতে হবে ৩০ হাজার টাকা, এছাড়া নিচের অংশের জন্য গুনতে হবে ২০ হাজার টাকা।
আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে দুই শতাধিক ডিজিটাল বিলবোর্ড স্থাপন করেছে ট্রেডম্যাক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. আশরাফ জানান, চট্টগ্রাম শহরের ফ্লাইওভারে স্থাপিত বিজ্ঞাপন বোর্ডগুলো তারা সিটি কর্পোরেশন থেকে টাকার বিনিময়ে ইজারা নিয়েছে।
অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় তালিকাভুক্ত ১৪১টি বিজ্ঞাপনী সংস্থা নগরীতে বিলবোর্ড স্থাপনের কাজ করলেও এখন বৈধ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে স্থাপিত রূপালী গিটারের সামনে বিলবোর্ডটি স্থাপন করেছিল। বিষয়টি জানার পর আমরা গিটারের সামনে থেকে সেই বিলবোর্ডটি সরিয়ে নিয়েছি। এর বাইরে শহরে কোনো কোম্পানিকে বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।'
সিডিএ'র নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী মো. আবু ঈসা আনছারী টিবিএসকে বলেন, 'নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের বিষয়টি সিটি কর্পোরেশন দেখভাল করে। এটির সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়ের বিষয়টিও জড়িত। এ অবস্থায় চসিক যদি বলে বিলবোর্ড স্থাপনের বিষয়টি তাদের জানা নেই; তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে তাহলে নগর কারা চালাচ্ছে?'
এর আগে ২০১৫ সালে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর চট্টগ্রাম নগরীকে বিলবোর্ডমুক্ত করার ঘোষণা দেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।
২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি রাত থেকে বিলবোর্ড অপসারণে নগরীতে 'ক্র্যাশ প্রোগ্রাম' শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি এই অভিযানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও অংশ নিয়েছিলেন।
সে সময় নগরীতে বিলবোর্ড, ইউনিপোল ও মিনিপোল ছিল ছয় হাজারের মতো। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬৬টি কর্পোরেশনের নিজস্ব জায়গায়, বাকিগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন ও অন্যান্য সরকারি স্থানে স্থাপন করা হয়েছিলো, যা পরবর্তী সময়ে অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়। ফলে নগরীর বিভিন্ন পাহাড় এবং দৃষ্টিনন্দন স্থান দীর্ঘদিন পর নগরবাসীর দৃষ্টিসীমায় আসতে শুরু করে।
সে সময় নগরীতে নতুন করে আর কোনো বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে না বলে তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়র নাছির। পরে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে নগরীর চকবাজার, খুলশী, দেওয়ানহাট ব্রিজ, জিইসি সংলগ্ন এলাকায় আবার দুয়েকটি করে বিলবোর্ড দেখা যেতে থাকে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয় গণমাধ্যমে আবার আলোচনা শুরু হলে বিলবোর্ড উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে চসিক।