আজিমপুর মাতৃসদন: দুর্নীতির মামলায় ৮ চিকিৎসকসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট দাখিল
রাজধানীর আজিমপুরে মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কেনাকাটায় দুর্নীতি সংক্রান্ত ৩ মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ৮ চিকিৎসকসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার (৭ জুলাই) কমিশনের অনুমোদনক্রমে আদালতে তিন মামলার চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. আতাউর রহমান সরকার।
সদ্য চার্জশিট হওয়া মামলাগুলোতে মোট ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৯২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে বলে টিবিএসকে নিশ্চিত করেছে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র।
ঘটনার শুরু ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর। রেজিস্ট্রেশন না করার অজুহাতে প্রসব যন্ত্রণায় কাতর ছিন্নমূল নারী পারভীনকে হাসপাতাল থেকে রাস্তায় বের করে দেয় আজিমপুরের মাতৃসদন কর্তৃপক্ষ। এরপর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন ওই নারী। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
মূলত আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নামের বিশেষায়িত এ হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা। আর এ হাসপাতালটিতেই ঘটেছিল নির্দয় আলোচিত ঘটনাটি। এরপর থেকেই অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় দুদকের তদন্ত।
জানা যায়, শুধু ওষুধ নয়– সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজি আইটেম ক্রয়ের নামে সেখানে চলেছে হরিলুট। বাজার দরের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে হয়েছে কেনাকাটা।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রতারণা ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এমআরপি ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকা অনুযায়ী মেডিসিন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকাশিত মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল রিকুইজিট (এম.এস.আর সামগ্রীর মূল্য তালিকা অনুযায়ী) করেননি।
শুধু তাই নয়, দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতার দর অনুমোদন না করে মনগড়া ও ভিত্তিহীন দরকে বিবেচনা করেছেন এবং স্ট্যান্ডার্ড রেটের বেশি দরে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঠিকাদারকে টাকা আত্মসাতে সরাসরি সহায়তা করেছেন।
অনুমোদন না নিয়ে এবং অতিরিক্ত দামে ওষুধসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগে বলা হয়, একে অপরের সহায়তায় প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে মেডিসিন, সার্জিক্যাল আইটেম অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার ক্ষেত্রে বিধিমালা লঙ্ঘন করেন তারা। এতে ২০১৪-২০১৮ সাল অর্থাৎ, চার অর্থবছরেই হাতিয়ে নেওয়া হয় ৫ কোটি টাকার বেশি।
২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর পৃথক চারটি মামলা করে দুদক। মামলার পরপরই আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মামলায় ১৭ জন চিকিৎসক ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ৮ জনকে আসামি করা হয়। আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ইসরাত জাহানকে আসামি করা হয় ৪ মামলাতেই।
সদ্য ৩টি মামলার চার্জশিটে ৮ জন ডাক্তার, সংশ্লষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তা ও দুই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীসহ মোট ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইসরাত জাহান ছাড়াও ডা. মো. আমীর হোসাইন, ডা. মো. লুৎফুল কবীর খান, ডা. বেগম মাহফুজা দিলারা আকতার, ডা. রওশন হোসনে জাহান, ডা. নাদিরা আফরোজ, ডা. আলেয়া ফেরদৌসি, ডা. রওশন জাহানের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা সবাই তৎকালীন ওষুধ ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও প্যাথলজি আইটেম কেনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এছাড়াও কেনাকাটা করা প্রতিষ্ঠান নাফিসা বিজনেস কর্ণার ও মেসার্স মনার্ক এস্টাব্লিশমেন্ট এর মালিক যথাক্রমে শেখ ইদ্রিস উদ্দিন (চঞ্চল) ও ফাতে নূর ইসলামকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সাবেক সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন, সাবেক সমাজসেবা কর্মকর্তা বিলকিস আক্তার, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নাছির উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, তারা একে অপরের সহায়তায় প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে মেডিসিন, সার্জিক্যাল আইটেম অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করেন। তারা এমআরপি ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মূল্যতালিকা মোতাবেক মেডিসিন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত মেডিক্যাল অ্যান্ড সার্জিক্যাল রিকুইজিট (এমএসআর) সামগ্রীর মূল্যতালিকা মোতাবেক সার্জিক্যাল আইটেম অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট কেনেননি।
আরও বলা হয়, আসামিরা এসআর বহির্ভূত আইটেম কেনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিদ্যমান বাজারদরকে আমলে না নিয়ে, গঠিত বাজারদর যাচাই কমিটির প্রণীত মনগড়া ও ভিত্তিহীন দরকে বিবেচনায় নিয়ে এমআরপি ও এসআর (স্ট্যান্ডার্ড রেট) রেটের ঊর্ধ্বে দরপত্র মূল্যায়ন ও অনুমোদনের মাধ্যমে মালামাল কেনেন— যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।