গুলিতে ছিন্নভিন্ন জীবন: পঙ্গুত্বের শঙ্কায় অর্থোপেডিক হাসপাতালে গুলিবিদ্ধরা
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)- এর ক্যাজুয়ালটি ব্লকে শতাধিক গুলিবিদ্ধ আহতরা পঙ্গুত্বের শঙ্কায় দিন পার করছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনের সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কাটা হয়েছে পা। তবে বেঁচে থাকার স্বার্থে পা কাটতে হলেও মেনে নিতে পারছেনা স্বজনরা। ফলে হাসপাতালে বাড়ছে মা-বাবাসহ নিকটাত্মীয়দের আহাজারি।
হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তাররা জানিয়েছেন, আহতদের অধিকাংশই শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।
গত মঙ্গলবার বিকেলে গুলিবিদ্ধ নাদিম হোসেনের (১৬) পা কাটতে অপারেশন করেন ডাক্তাররা।
নাদিমের মা মরিয়ম খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শনিবার বিকেল ৫টায় ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে বাসায় ফিরছিল নাদিম। পথিমধ্যে চিটাগাং রোডের ডাচবাংলা ভবন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় আমার ছেলে। পথচারীরা একটা প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে গেলে সেখানে শুধু রক্তপাত বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। পরে, আমরা খোঁজ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে গুলি বের করে নিটোরে পাঠিয়ে দেয়।"
নাদিমের বাবা মো. দুলাল হোসেন বলেন, "ডাক্তাররা বলে ছেলেকে বাঁচাতে হলে পা কাটতে হবে। প্রথমে আমাদের মানতে কষ্ট হচ্ছিলো, পরে বাধ্য হয়ে অপারেশন করাই। ছেলেটা এই বয়সে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলো মানতে পারছিনা।"
১৬ বছরের নাদিম হোসেন কাচপুরের একটি ক্ষুদ্র পোশাক কারখানায় অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করতেন। ৮ হাজার টাকা বেতন তুলে দিতেন রিকশাচালক বাবা মো. দুলাল হোসেনের (৪৮) হাতে। চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার খাজুরিয়া লক্ষীপুর গ্রামের দুলাল হোসেন কাজের খোঁজে ২০১৮ সালে নারায়নগঞ্জের চিটাগং রোডে আসেন।
তিন ভাইয়ের মধ্যে নাদিম পরিবারের বড় সন্তান।
ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নাদিম হোসেন বলেন, "আমার জীবনে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই। পুলিশের গুলিতে আমার এক পায়ের সাথে সাথে আশা-ভরসাও সব নাই হয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল কিছু টাকা পয়সা কামাই করে গ্রামে যাবো।"
দুলাল হোসেন বলেন, "অভাবের তাড়নায় বড় ছেলেকে পড়াতে পারিনি। মাত্র ক্লাস ফোরে উঠেছিল, তখন থেকেই আয় রোজগার করার জন্য বিভিন্ন কাজ শুরু করে নাদিম।"
নাদিমের বাবা-মা জানালেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। আগামী দিনে ওষুধপত্র কেনা নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন; ঠিক সময়ে ডাক্তারের কথামতো ওষুধ কিনতে পারবো কি-না, তা নিয়ে শঙ্কা। হাসপাতালে আরও একমাসের মতো থাকতে হতে পারে নাদিমকে।
আরেক গুলিবিদ্ধ আহত ফরহাদ হোসেন (৩৫) রামপুরায় রিকশা চালাতেন। রিকশা নিয়ে রাস্তায় চলার সময় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডানপায়ে গুলি লাগে ফরহাদের। স্থানীয়রা অন্যান্য আহতদের সাথে ফরহাদকেও তুলে দেন এক অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে। সেখানে গুলি বের করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করে নিয়ে আসা হয় নিটোরে।
ফরহাদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে আমার মতো অনেকেই আহত হয়েছেন। কিন্তু আমার অবস্থা অন্যদের থেকে আলাদা। আমাকে তো এখন ঋণ করে হাসপাতালে ৭ দিন ধরে বসে থাকতে হচ্ছে। আল্লাহর কাছে এখন একটাই চাওয়া, আমার পা যেনো থাকে; না হলে আমার কিছু করে বেঁচে থাকার উপায় থাকবে না।"
১৮ বছরের আরেক নাদিম রায়েরবাগের এক মুদি দোকানে কাজ করতেন। রায়েরবাগ থেকে মিরপুরের বাসায় ফেরার সময়ে শুক্রবার দুপুরে একপায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রাইভেট হসপিটাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঘুরে নিটোরে উপস্থিত হয়েছেন।
নাদিমের বড়ভাই মো. নাইম বলেন, "ইতোমধ্যে পায়ের দুটো অপারেশন করা হয়েছে। এরপরে আরেকটা অপারেশন হবে। তবে এখনো বলা যাচ্ছে না নাদিমের বাম পায়ের ভবিষ্যৎ কী। ডাক্তার এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি।"
এছাড়া কাজলার সিএনজি ড্রাইভার আমিরুল, উত্তরা আজমপুরের দিনমজুর উজির মিয়ার আহত হওয়ার ধরনও একইরকম।
হাসপাতালের পরিচালক কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, গত ১৭ জুলাই থেকে এই প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৭০০ এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে ৬৮৬ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন।
প্রতিষ্ঠানের একাধিক ডাক্তার ও নার্স জানিয়েছে, দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোগী ১৯ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ভর্তি হন। যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জনের পা কাটতে হয়েছে। এছাড়া, একটি বড় সংখ্যক রোগী পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে— যাদের গুলিবিদ্ধ হাত অথবা পা কাটতে হতে পারে।
গুলিবিদ্ধ রোগীদের অঙ্গহানির ব্যাপারে নিটোরের ইয়োলো-১ ইউনিট চিফ অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, "যেসব রোগী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং রক্তনালি বা ধমনি ছিঁড়ে গেছে তাদের পা কাটতে হয়েছে। কেননা এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাংস পচে যাবে বা মরে যাবে। এতে পরবর্তী সময়ে রোগীর শারীরিক অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। কিডনিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোগীকে বাঁচাতেই আক্রান্ত অঙ্গটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।"
তিনি আরও বলেন, "কাটা পায়ে সেলাই করতে হবে আরও পরে। কেননা কাটা জায়গা থেকে রস পড়বে। তা শুকাতে হবে। ফলে অনেক রোগীকে হাসপাতালে দীর্ঘ সময় থাকতে হবে।"