সাভার, ১৮ জুলাই: ইয়ামিনকে যেভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ
১৮ জুলাই সাভারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করার দায়িত্বে ছিলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সাভার প্রতিনিধি নোমান মাহমুদ। সেদিন সারাদিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। এমআইএসটি-এর শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার দৃশ্যও দেখেছেন তিনি। সেই প্রত্যক্ষদর্শী-বিবরণ এখানে প্রকাশ করা হলো। এ লেখায় কিছু স্পর্শকাতর বর্ণনা রয়েছে।
১৮ই জুলাই, বৃহস্পতিবার। বেলা ১১টা পর্যন্ত সাভারের সার্বিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ১১টার পর থেকে। ১১টার দিকে সর্বপ্রথম এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সাভারের ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের পাকিজা মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এরপর বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা পাকিজা এলাকায় অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে স্লোগান দিতে শুরু করেন। পুলিশ তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। ভাঙচুর করা হয় একাধিক পুলিশ ভ্যান।
পুলিশের মুহুর্মুহু টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের মুখে এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
প্রায় একই সময়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে মাথায় হেলমেট পরে সশস্ত্র অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী। তাদের সবার হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, রামদা; এমনকি বেশ কয়েকজনের হাতে পিস্তল ও শটগান ছিল। সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের আত্মীয় রুবেলসহ আরও অনেকেই সেদিন আগ্নেয়াস্ত্রসহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনকারীরা ত্রিমুখী আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা শক্ত অবস্থান নেন ওই এলাকায়। পাকিজা মসজিদের সামনে তখন কয়েকশ পুলিশ-বিজিবি সদস্য অবস্থান করছিলেন।
অন্যদিকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা পুনরায় জড়ো হতে শুরু করেন সাভার বাস স্ট্যান্ড এবং এর আশপাশের বিভিন্ন গলি ও পয়েন্টগুলোতে।
বেলা ১২টা: দফায় দফায় সংঘর্ষ
বেলা সোয়া ১২টা নাগাদ দ্বিতীয় দফায় আবারও আন্দোলনকারীরা পাকিজা মোড় থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত সাভার মডেল মসজিদের সামনের মহাসড়কে নেমে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সড়কে নেমে আসেন স্থানীয়রাও।
আবারও শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। একদিকে পুলিশ, বিজিবি সদস্য এবং সশস্ত্র আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা, অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-জনতা।
পুলিশের মুহুর্মুহু টিয়ারশেল আর গুলির মুখে এবার আন্দোলনকারীরা আবারও কিছুটা পিছু হটে অবস্থান নেন সাভার মডেল মসজিদসংলগ্ন ব্যাংক কলোনী মহল্লার গলিসহ আশপাশের গলিগুলোতে।
সেখানে প্রায় আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে সাভার বাস স্ট্যান্ড এলাকার পুরাতন ওভার ব্রিজ, সিটি সেন্টার, রাজ্জাক প্লাজা ও মহাসড়কের বিপরীতদিকের সার্ভিস লেন এবং অলিগলিগুলোতে অবস্থান নেন। পুরাতন ওভার ব্রিজের নিচে মহাসড়কের আরিচাগামী লেনের মূল লেনে লোহার ব্যারিকেড ও আগুন জ্বালিয়ে মহাসড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা এলাকা।
ততক্ষণে সাভার বাস স্ট্যান্ড এলাকার একাধিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে দিয়েছেন উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা।
তাদের লক্ষ্য করে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ চলতেই থাকে। কিছুক্ষণ পরপর আন্দোলনকারীরা কিছুটা পিছু হটলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পুনরায় হামলা চালান আন্দোলনকারীদের ওপর।
এ পর্যায়ে এসে আন্দোলনকারীদের শক্ত অবস্থান তৈরি হয় মহাসড়কের নবীনগরগামী সার্ভিস লেনের রাজ্জাক প্লাজা ও তার আশপাশের পয়েন্টে। তাদের একটি অংশ তখন মহাসড়কের বিপরীতদিকের সার্ভিস লেন ও বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নেন।
আর সে মুহূর্তে পুলিশের অবস্থান ছিল মহাসড়কের পাকিজা এলাকা থেকে নবীনগরমুখী সার্ভিস লেনের বাজার রোড পর্যন্ত। বিজিবি সদস্যরা তখন পাকিজা এলাকায় অবস্থান করেন। কিছু সময় পরপর বিজিবি সদস্যরা সামনে এগোলেও আন্দোলনকারীদের ছোড়া বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেলের মুখে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হন তারা।
দুপুর ২টা: এপিসি এল
পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালীন দুপুর ২টা বা তার কিছুসময় পর আন্দোলনকারীদের দমনে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের মূল সড়কের নবীনগরমুখী লেনে পুলিশের একটি নেভি ব্লু রংয়ের এপিসি [আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার] এসে যোগ দেয়।
যেহেতু নবীনগরমুখী সার্ভিস লেনেই অবস্থান করছিলেন পুলিশ সদস্যরা, তাই মহাসড়কের উঁচু আইল্যান্ড পেরিয়ে সড়কের বিপরীতদিকে অবস্থান করা আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পারছিলেন না তারা।
এ পর্যায়ে পুলিশের এপিসিটি মহাসড়কের মাঝে অবস্থান নেয়। ভেতরে অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের দিকে রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করেন।
এপিসিটির ভেতরে তখন পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন।
সোয়া ২টা থেকে ২টা ২০ মিনিট নাগাদ পুলিশের এপিসিটি যখন সাভার বাস স্ট্যান্ডের পুরাতন ওভারব্রিজের কাছাকাছি অবস্থানে ছিল, তখন মহাসড়কের বিপরীত দিক থেকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন কোনো এক ফাঁকে প্রথমে সার্ভিস লেন ও মূল সড়কের উঁচু বিভাজক এবং পরে মূল সড়কের মাঝের লোহার সড়ক বিভাজক টপকে পুলিশের এপিসিটির ওপরে উঠে যান।
আন্দোলনকারী এ শিক্ষার্থীর নাম শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। এপিসির ওপরে ওঠার পরপরই বুকের বাম পাশে [ছররা] গুলিবিদ্ধ হয়ে এপিসির ছাদেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।
তার পরনে ছিল নেভি ব্লু রংয়ের একটি ট্রাউজার এবং গায়ে খয়েরি রংয়ের একটি জামা। ইয়ামিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই বন্ধ করে দেওয়া হয় এপিসির ওপরের প্রবেশপথের ঢাকনাটি [হ্যাচ]।
বাইরে থাকা শতশত পুলিশ সদস্য তখনও মহাসড়কের বিপরীতদিকে থাকা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে একের পর এক ছররা ও রাবার গুলি ছুড়ছিলেন।
যেভাবে এপিসি থেকে ফেলা হয় ইয়ামিনকে
এপিসির ওপরে ইয়ামিন লুটিয়ে পড়ার পর যানটি অবস্থান পরিবর্তন করে পেছনের দিকে সরে আসতে থাকে। এটি যখন সাভারের রানা প্লাজা ও ভ্যাট অফিসের মাঝামাঝি অবস্থানে আসে, তখন এপিসির ভেতর থেকে এক পুলিশ সদস্য বামদিকের একটি দরজা খুলে এবং আরেকজন এপিসির হ্যাচ খুলে ওপরে বেরিয়ে টেনে ইয়ামিনকে নির্মম ও অমানবিকভাবে সড়কে ফেলে দেন।
তখনও জীবিত ছিলেন ইয়ামিন। সড়কে পড়ে থাকা এ শিক্ষার্থীকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখা যায়। তার দুহাত দুদিকে ছড়ানো। পা দুটি ভাঁজ হয়ে পড়ে। একটি পা গিয়ে ঠেকে এপিসির বাম দিকের পেছনের চাকার গায়ে।
এ সময় এপিসির বামদিকের দরজা দিয়ে পুলিশের প্রথম সদস্য নেমে ইয়ামিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে এপিসির চাকার পাশ থেকে সরিয়ে মহাসড়কের মাঝের দিকে টেনে নিয়ে আসেন।
এর কয়েক মিনিট পর এপিসিতে থাকা দুজন পুলিশ সদস্য আবারও ইয়ামিনকে ধরে মূল সড়কের বিভাজকের ওপর থেকে সার্ভিস লেনে অমানবিকভাবে ফেলে দেন।
ইয়ামিনকে যেভাবে প্রথমে এপিসির ছাদ থেকে এবং পরে সড়ক বিভাজক পার করিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলা হয়, তাতে মনে হচ্ছিল কোনো মানুষ নন, বরং কোনো পণ্যের বস্তা ফেলা হচ্ছে। করুণ, মর্মান্তিক ও অমানবিক এ দৃশ্য কাঁদিয়েছে অনেককে।
ইয়ামিনকে সার্ভিস লেনে ফেলে দেওয়ার পরপরই তার অবস্থানের কাছেই আরেকটি টিয়ারশেল পড়ে। শেলের ঝাঁঝালো গ্যাসের কারণে সবাই তখন ইয়ামিনকে সড়কে সেভাবেই ফেলে রেখে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রায় একঘণ্টা পর কয়েকজন আন্দোলনকারী ইয়ামিনকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় দেখা যায়, শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের বুকের বাম পাশ ও গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন।
ইয়ামিন ছিলেন এ আন্দোলনে ঢাকার সাভারে নিহত প্রথম শিক্ষার্থী। তিনি রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।