৫ আগস্টের হটস্পট যাত্রবাড়ী থানায় জনবল সংকট, চলছে ধার করা গাড়ি দিয়ে
২৭ বছর বয়সি রিয়াদ (ছদ্মনাম) যাত্রবাড়ী থানায় এসেছেন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে। ডিউটি অফিসারের কক্ষে আধাঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করেও সিরিয়াল পাননি তিনি।
রিয়াদ সম্প্রতি মানিব্যাগ হারিয়েছেন। তাতে তার মায়ের নামে নিবন্ধিত একটি সিম কার্ড ছিল। তার মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। এ অবস্থায় সিম উত্তোলনের জন্য কাস্টমার কেয়ার থেকে বলা হয়ছে জিডি কপি নিয়ে যেতে।
'এ ঘন্টার মতো হয়ে গেছে, এখনও আমার সিরিয়াল আসেনি,' বলেন রিয়াদ।
ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) সাখায়েত হোসেন। তার পাশে বসে ছিলেন একজন নারী পুলিশ সদস্য। তার টেবিলে একটি মাত্র কম্পিউটার। বিপরীত পাশে রিয়াদসহ ৫-৬ জন মানুষ। তাদের কেউ মামলা, কেউ বা জিডি করতে এসেছেন।
সাখায়েত বলেন, 'আগে তিন থেকে চারটি কম্পিউটার ছিল। এখন মাত্র একটি। প্রতিদিন শতাধিক জিডি লিখতে হয়। ফলে কেউ জিডি করতে এলে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।'
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০০টির বেশি থানায় হামলা হয়। এর মধ্যে আছে রাজধানীর যাত্রবাড়ী থানাও। বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ছয়তলা থানা ভবন।
শুরুতে পার্শ্ববর্তী ডেমরা থানার দুটি কক্ষ নিয়ে পুলিশি কার্যক্রম শুরু করলেও অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আগের ভবনে ফিরে আসে যাত্রাবাড়ী থানা। সংস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও সীমিত সরঞ্জাম, জনবল ও যানবাহন সংকটের মধ্যেই চলছে পুলিশি কার্যক্রম।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক হোসেন বলেন, 'সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে ভবনের সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার আগেই আমরা এখানে কার্যক্রম শুরু করেছি। কিছু সংকট থাকলেও সবাইকে সেবা দেওয়া হচ্ছে।'
২৩ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, থানা ভবনের চারপাশ কাটাঁতারে ঘেরা, যাতে কেউ দেওয়াল টপকে থানা এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। সদ্য রং ও চুনকাম করায় ভবনটি বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। প্রধান ফটক হয়ে থানা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেখা গেল পোড়া গাড়ির স্তূপ। পাশে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন সজিব নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা।
সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, 'এই থানায় পুরাতন কোনো পুলিশ সদস্য নেই। সবার নতুন পোস্টিং হয়েছে। পোড়া গাড়িগুলো এখনও আছে। আসবাবপত্র, গাড়ি থেকে শুরু সবকিছু নতুন করে আনা হচ্ছে।'
ভবনের বাহ্যিক রঙের কাজ শেষ হলেও আসবাবপত্র পুরোপুরি সেট করা হয়নি বলে জানালেন সজিব। জানালার গ্লাস লাগানোর কাজ চলছে।
ওসি ফারুক হোসেন তখন থানায় ছিলেন না। মুঠোফোনে জানালেন, অপারেশনে আছেন, ফিরতে সময় লাগবে। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিলেন।
দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই হাতের বাম পাশের কক্ষটি ডিউটি অফিসারের। ডিউটি অফিসার হিসাবে ওইদিন দায়িত্বে ছিলেন সাখায়েত হোসেন।
তিনি জানান, থানায় পুলিশি কার্যক্রম পুরোপুরি চলছে। তবে জনবল, টহল গাড়ি ও অন্যান্য লজিস্টিকের সংকট থাকায় সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা অনুযায়ী পূর্ণ সেবা পাচ্ছে না।
ধার করা পুরাতন গাড়িতে চলছে থানার কার্যক্রম
থানা সূত্রে জানা যায়, যাত্রাবাড়ী থানায় আগে ৭টি গাড়ি ছিল। ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার দেওয়া আগুনে সবগুলো গাড়ি পুড়ে যায়। পরবর্তীতে ডিএমপি থেকে একটি নতুন গাড়ি দেওয়া হয়। এছাড়া তেজগাঁও থানা থেকে দুটি পুরাতন গাড়ি ধার নেওয়া হয়।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুরনো গাড়িগুলো প্রায়শই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অভিযান ও টহল কার্যক্রমে এগুলো নিলে ভেগান্তিতে পড়তে হয়।
একজন এসআই টিবিএসকে বলেন, তেজগাঁও থানার ধার করে আনা পুরনো গাড়িগুলো প্রায়ই নষ্ট হয়। এতে পুলিশের সেবা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
জনবল সংকট
আগস্টের আগে যাত্রাবাড়ী থানায় জনবল ছিল ২৫৮ জন। তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ছিলেন ২০৬ জন ও আনসার সদস্য ৫২ জন। বর্তমানে এই থানায় জনবল দেড় শতাধিকের কিছু বেশি।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ৫ আগস্টের হামলা ও অগ্নিসংযোগের কারণে মামলার নথিপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফলে ওয়ারেন্টভুক্ত অনেক আসামি এখনও মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা গ্রেপ্তার করতে পারছে না। জনবল সংকট থাকায় নিয়মিত আদালত থেকে ওয়ারেন্ট অর্ডার আনাও দুষ্কর ।
একজন এসআই বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিনতাই বাড়ছে। প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। 'ছিনতাই, চুরি—এগুলোর চক্র থাকে। আগের মামলার নথিপত্র থাকলে এসব চক্রকে শনাক্ত করতে সুবিধা হতো। এছাড়া অনেক ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না নথিপত্র না থাকায়।'
তিনি আরও বলেন, 'আদালত থেকে ওয়ারেন্টের কাগজপত্র আনার জন্য নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। জনবল সংকটে থাকায় আমাদের ওপর চাপ পড়ছে।'
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রবাড়ী থানার ওসি ফারুক হোসেন বলেন, 'আমাদের সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমারা সেবা দিচ্ছি। তবে সীমাদ্ধতাও ধীরে ধীরে আমরা কাটিয়ে ওঠছি। ইতিমধ্যে নতুন ভবনকে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে। নতুন চেয়ার-টেবিল আনা হয়েছে। নতুন পোস্টিং হলে জনবল সংকটও কেটে যাবে।'