এবার সত্যজিতের 'পথের পাঁচালী-চারুলতা' প্রদর্শনে আপত্তি!
প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' ও 'চারুলতা' সিনেমায় বিতর্কিত বিষয়বস্তু রয়েছে দাবি তুলে উড়িষ্যার কটকের র্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দুটি প্রদর্শনে আপত্তি জানিয়েছে একটি গোষ্ঠী। একদল 'ডানপন্থী' শিক্ষার্থীর অভিযোগের মুখে ছবি দুটি উৎসবে প্রদর্শনে জটিলতা তৈরি হয়ে বলে খবর দ্য অয়্যার-এর।
শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালে। এবারই প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করেছিল সংগঠনটি। ২ থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ছিল চলচ্চিত্র উৎসবের নির্ধারিত সময়সূচি। উৎসবে প্রয়াত বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিত রায়ের সিনেমাগুলোর ওপর বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। উৎসবে সত্যজিতের 'পথের পাঁচালী', 'গণশত্রু', 'চারুলতা'সহ আরও কিছু ছবি দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্কলার ও পরিচালক মৈনাক বিশ্বাস এবং বিখ্যাত আলোকচিত্রী পাবলো বার্থোলোমেউকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। র্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কমিটি এই চলচ্চিত্র উৎসবের অনুমতি দেয়।
কিন্তু গত ২ মার্চ ফিল্ম সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবী এবং শিক্ষকরা ক্যাম্পাসের হলে পৌঁছালে তাদেরকে বলা হয় যে ভেন্যু ফাঁকা নেই। ফিল্ম সোসাইটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভ নায়েক হলের কেয়ারটেকারদের আচরণে বিভ্রান্ত হয়ে উপাচার্যের কাছে যান এ ঘটনার ব্যাখ্যা চাইতে।
শুভ নায়েকের ভাষ্যে, "উপাচার্য জানান যে এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার পেছনে তিনি দায়ী নন। অন্য কোনো ব্যক্তির এটি নিয়ে সমস্যা রয়েছে।"
এরপরে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করলে আশেপাশের নানা সূত্রে তারা জানতে পারেন যে, র্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি স্কলার চিন্ময় সাহু স্থানীয় মালগোডাউন থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন এই মর্মে যে- এই চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য রাখা কিছু সিনেমায় 'বিতর্কিত' বিষয়বস্তু রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কমিটির চেয়ারওমেন অধ্যাপক উর্মিশ্রী বেদামত্ত বলেন, কমিটি ঐ শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করেছে এবং তার কিছু দাবি মেনে নিয়েছে; যেমন- 'গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি' ও 'হাদ আনহাদ' এর মতো সিনেমাগুলো প্রদর্শন করবে না তারা।
তিনি আরও যোগ করেন, "যখন আমরা ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বললাম তখন বুঝতে পারলাম যে তার আসলে নির্দিষ্ট কোনো সিনেমা নিয়ে সমস্যা নেই, বরং তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে এই চলচ্চিত্র উৎসবটা হতে দেবে না। আর আমরা যখন বুঝতে পারলাম যে এই ব্যক্তির আসলে সিনেমা নিয়ে জ্ঞান খুবই কম এবং সচেতনতা নেই, তখনই আমরা তার কোনো দাবির দিকে আর পাত্তা দেইনি।" যদিও নিজের কথায় একবারও সাহুর নাম উল্লেখ করেননি উর্মিশ্রী।
এদিকে শুভ নায়েক জানান, সাংস্কৃতিক কমিটির সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ সমিতির ডিন অলকা নন্দা পারিদা শিক্ষার্থীদের এও জানিয়েছেন যে, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার বিরুদ্ধে সাহুর অভিযোগগুলো খুবই অদ্ভুত!
তিনি বলেন, "তিনি (সাহু) অভিযোগ করেছেন যে সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'তে দ্রৌপদির অপমান করা হয়েছে। কোনোদিন সিনেমা না দেখেই তিনি ভেবে নিয়েছেন 'পাঁচালী' হলো দ্রৌপদির একটা নাম। কিন্তু বাংলা শব্দ 'পাঁচালী'র মানে অনেকটা 'বর্ণনামূলক গান' বোঝায়। এর সঙ্গে মহাভারতের কোনো সম্পর্কই নেই।"
সাহুর রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সংযোগ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি উর্মিশ্রী বেদামত্ত। যদিও টুইটারে অনেকগুলো টুইটেই দাবি করা হয়েছে যে র্যা ভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চলচ্চিত্র উৎসবের বিরোধিতার পেছনে আরএসএস-এর যুবদল এবিভিপি'র হাত রয়েছে। শুভ নায়েক জানান, 'হরি ওম' নামক আরও একটি গোষ্ঠী ক্যাম্পাসে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই চলচ্চিত্র উৎসবের বিরোধিতা করছে।
শুভর ভাষ্যে, তারা এও অভিযোগ তুলেছে যে 'পথের পাঁচালী'তে ভারতের দারিদ্রতাকে রোমান্টিসাইজ করা হয়েছে এবং এ ধরনের সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত আরেকটি চলচ্চিত্র 'চারুলতা'য় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ছোট করে দেখা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছে এই গোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে 'চারুলতা'।
তবে প্রাথমিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত শুক্রবার সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছে ফিল্ম সোসাইটি কর্তৃপক্ষ।