মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান রোহিঙ্গাদের জন্য শাপে বর হতে পারে
মিয়ানমারে একটি সেনানিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাত্র তিন মাস পরেই সেনা-অভ্যুত্থান ঘটবে—ঝানু কূটনীতিকরাও কখনো ভাবতে পেরেছিলেন কি? এইরকম কিছু ঘটতে পারার কোনো সম্ভাবনা পশ্চিমা বিশ্বই বা কতটুকু অনুমান করতে পেরেছিল? তাদের তো গোয়েন্দা ক্ষমতার অভাব নেই! তবে এটি এখন সুস্পষ্ট যে পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স চীনা ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতার তুলনায় খানিকটা পিছিয়েই রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে অনুমান করতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে বাংলাদেশের সব মহলে প্রশ্ন বেড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সুরাহা কী হবে, কীভাবে হবে—ইত্যাদি। বেশিরভাগ ধারণাই এমন যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়ে গেল সম্ভবত।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র জিনহুয়ার চোখে অভ্যুত্থানটি শুধুই 'মন্ত্রীপরিষদে অদলবদল'। সামরিক শাসকরাও জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। যা যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। ভারত জানিয়েছে ভারতের কালাদান নদীসংযোগ প্রকল্পের কার্যক্রম যথারীতি চলবে এবং যথাসময়ে শেষও হবে। সেনাশাসকদের আশা ছিল রাশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় বেশিরভাগ দেশের সমর্থন তারা ঠিকঠিক পেতেই থাকবে। কিন্তু তা পুরোপুরি হয়নি। সিঙ্গাপুর এবং জাপান বাণিজ্যে রাশ টেনেছে। মার্কিন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদিতে থেমে না থেকে জেনারেলদের ভ্রমনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রতিদিনই তালিকায় দু একজন নতুন নতুন সেনা অফিসারে নাম যুক্ত হচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার দলীয় এমপি রুশানারা আলি এবং ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট এমপি বেশ কিছুদিন যাবত রোহিঙ্গা বিষয়ে বৃটেনকে কঠিন অবস্থান নেওয়ার দাবী জানিয়ে চলেছেন। সম্ভবত সফলও হতে চলেছেন। তারা চাইছেন মায়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাম্বিয়া, কানাডা এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যুক্তরাজ্যও যুক্ত হোক। রোহিঙ্গা প্রবাসীরা সেনাবিরোধী আন্তর্জাতিক মনোভাব তৈরিতে একাট্টা হয়ে নেমেছে। মিয়ানমারের বড় বড় শহরগুলোতে রাস্তার আন্দোলনকারীদের অনেকেই ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডে লিখে রেখেছে রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারে তারা এখন অনুতপ্ত। বিশ্বদরবারে মিয়ানমারকে একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দানবীয় রাষ্ট্রের প্রতিমূর্তিরূপে পরিচিত করানোর কারণে সেনাশাসকদের তারা আর ক্ষমা করতে রাজি নয়। ভীতি কাটিয়ে তারা চীনা দুতাবাসের সিসিক্যামেরার মুখে প্রতিবাদী ভাষ্য তুলে ধরছে। চীন যখন দাবি করেছে যে বড় বড় লরিতে অস্ত্র নয়, মাছ পাঠাচ্ছে দেশটি—আন্দোলনকারীরা চীনা দূতাবাসের সামনে বিশাল ব্যানারে দূতাবাসকে 'মাছের আড়ত' নাম দিয়ে বিদ্রুপ করে চলেছে নির্ভয়ে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের আসলে কী করা দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নামলে প্রাক্তন ও বর্তমান কূটনীতিক মহলের সদস্যদের ভাবনাগুলো জানা দরকার হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম এ রকম রাজনীতিক এবং রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠায় লেগে থাকা নানা রকম সংস্থার প্রতিনিধিদের মতামতও জানতে হয়। এই ভাবনার আলোকে ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে কানাডার উইনিপেগ শহরে কনফ্লিকট অ্যন্ড রেজিলিয়েন্স ইন্সটিটিউট কানাডা (ক্রিক) একটি বিশেষজ্ঞ সংলাপের আয়োজন করে। আলোচনায় ছিলেন বেশ কয়েকজন কূটনীতি-বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার ও শরনার্থি সমস্যা বিশেষজ্ঞ। যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সম্প্রতি অবসরে যাওয়া পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক, কানাডায় নবনিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. খলিলুর রহমান, ব্রিটেনের পার্লামেন্টের লেবার দলীয় সংসদ সদস্য, এবং ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনরত ক্যাথরিন ওয়েস্ট এমপি, এবং যুক্তরাজ্যের রোহিঙ্গা বার্মিজ এসোসিয়েশনের প্রধান তুন খিন।
সংলাপটিতে বাংলাদেশের প্রাক্তন এবং বর্তমানের দুইজন কূটনীতিক তো বটেই, বৃটেনের দুইজন আলোচকও মিয়ানমারের ঘটনাপঞ্জির আলোকে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে বেশ খোলামেলা আলাপ করেন। দুইটি মূল পরামর্শ এসেছে কানাডায় নবনিযুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমানের কাছ হতে। তার প্রথম পরামর্শ ছিল এই যে মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে। এর কোনোই বিকল্প নেই। এবং কাজটি করা আন্তর্জাতিক সমাজেরই দায়। তার দ্বিতীয় পরামর্শটি ছিল রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কতোভাবে কীভাবে কতোটা ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার একটি চুলচেরা হিসেব রাখা শুরু করতে হবে, এবং সে জন্য নিরন্তর গবেষণাও চালিয়ে যেতে হবে। তার স্পষ্ট বক্তব্য—'রোহিঙ্গা আশ্রয়দানের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব-নিকেশের এখনই সময়। বাংলাদেশ কোন কোন খাতে কী রকম ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, সেই গবেষণাটি শুরু হওয়া দরকার'। তাঁর স্পস্ট অবস্থান এই যে আন্তর্জাতিক সমাজের দায়টি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
তার ভাষ্যটিকে যৌক্তিক মনে করার অনেক কারণ আছে। কারণগুলো জনাব শহিদুল হকের আলোচনায় স্পষ্ট রূপ নিয়েছিল। জনাব হকের বক্তব্যের সারমর্ম—আন্তর্জাতিক মহল সু কিকে মাথায় তুলেছিল। যদিও সু কি আসলে সেনা-কন্যা, এবং এক অর্থে সেনাদের ছায়াতেই বেড়ে ওঠা মানুষ। তার নোবেল প্রাপ্তি হতে শুরু করে মানবতাবাদের 'পোস্টার গার্ল' ইমেজটি তৈরি করা দরকার ছিল। ফলে সেনাদের ছাড় দেওয়া এবং দো-আঁশলা গণতন্ত্রের উদ্ভট মডেলটি তৈরি করা গেছে। ২০০৮ সালের সংবিধানের মাধ্যমে স্টেট কাউন্সিলর পদ সৃষ্টি করে ২০২১০ সালে সুকির ক্ষমতাগ্রহণ নিশ্চিত করা গেছে। তাতে দারুণ সুবিধাই হয়েছে ধনী দেশগুলোর। মিয়ানমারে তাদের লগ্নিজাত মুনাফা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তাই লগ্নিকারীরা এতদিন রোহিঙ্গা বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়নি।
২০১০এর নির্বাচনকে বিশেষ মহিমা দান করে,'বার্মা গণতন্ত্রের পথে বড়সড় কদম রাখছে' ছুতা দেখিয়ে ধনী দেশগুলোর বহজাতিকদের মাধ্যমে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হয় দেশটিতে। সেনাবাহিনীর অফিসাররা নিজেরাই বড়বড় আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থকরি কাজের দখল নিয়ে নেয়। দীর্ঘ ষাট বছর দেশটি কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর কব্জায়। এই ছয় দশক জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে সেনাবাহিনী দুর্ভেদ্য দূর্গ-দেওয়ালের মত শক্তিশালী কাঠামোয় বেড়ে ওঠেছে। শক্তিতে, কৌশলে ও সক্ষমতায় অসীম ক্ষমতাধর একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে। তারা সমরকৌশলও প্রশিক্ষণ নিয়েছে ইওরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সেনা-পুলিশ যে সব আগ্রাসি কৌশল নিয়েছে সেই প্রশিক্ষণগুলোও না-কি যুক্তরাজ্য হতেই পাওয়া।
দেশের অর্থনীতির সিংহভাগও নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনীই। সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থায় ৬০টিরও বেশি দেশের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। একটি অর্থ উপার্জনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া্য় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার বিকল্পও ছিল না। জেনারেল হ্লাইং-এর অবসরে যাবার মাত্র ছয় মাস বাকি ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভি্যুক্ত হওয়ায় এবং বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি প্রমাদ গুনছিলেন। সে কারণে তার স্ব-নিরাপত্তাহীনতার দুর্ভাবনা ছিল। সেই ভীতিবোধই সম্ভবত তাকে অভ্যুত্থানে বাধ্য করেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপর হতে দখলদারিত্ব হারানোর ভীতি।
কিন্তু এই ভীতি কাটাতে গিয়ে করা আকস্মিক অভ্যুত্থান মিয়ানমারের নাগরিকরা মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ মিছিল প্রতিদিনই দৈর্ঘ্যে বাড়ছে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে চাকুরে কর্মজীবীরাও ভয়ভীতি কাটিয়ে রাস্তায় নামছে। এবং শেষ খবর মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী চলমান বিক্ষোভে বুধবার দেশটির বিভিন্ন শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৩৮ জন প্রানিহত হয়েছেন। এক মাস সময়ব্যাপী চলা এই বিক্ষোভ শুরুর পর গতকালকের দিনটিকে 'সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন' হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
ফলে ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতিতে ধনী দেশগুলোর লগ্নিকারদের লগ্নি হারানোর ভীতিও বাড়ছে। দেশগুলোর লগ্নি সুরক্ষার কার্যক্রম এই মুহূর্তে সেনাশাসককে রক্ষার কার্যক্রমের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারি সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কে না জড়ানো ধনী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বড়ো একটি নৈতিক দায়। সুতরাং সেনাশাসকের বৈধতার বা অনুমোদনের সনদ পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং সেনাশাসককে চাপে রাখতে গিয়ে দেশগুলো রোহিঙ্গা গণহত্যা কার্ড খেলতে পারে। সেনাশাসকদের অপরাধ ও অপকর্মকে রাষ্ট্র করে তুলতে পারে। রোহিঙ্গাদের জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি ইতিবাচক হয়ে ওঠতে পারে। বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জোর দাবীর পক্ষে টানার চেষ্টা করতে পারে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের জন্য অন্তর্বর্তিকালীন একটি 'সেইফ জোন' বা 'নিরাপদ এলাকা' সৃষ্টির জোর কূটনীতি চালিয়ে যেতে পারে। এই সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন।
[লেখকবৃন্দের পরিচয়
- ড. হেলাল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
- ড. কাওসার আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট, কানাডা। ]