হামাসের সঙ্গে ৫০ জিম্মিকে মুক্তির চূড়ান্ত প্রক্রিয়া যেভাবে শেষ মুহূর্তে ভেস্তে গেল
গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু করার বেশ কয়েকদিন আগে বোমাবর্ষণে বিরতি দেওয়ার বিনিময়ে ৫০ জন পর্যন্ত জিম্মিকে মুক্ত করার জন্য হামাসের সঙ্গে চুক্তি করার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল ইসরায়েল। এ আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরব ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
তবে ২৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু করার পর দুপক্ষের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান কর্মকর্তারা। বেশ কয়েকদিন পর অবশ্য ফের সে আলোচনা শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত চলছে।
দুজন কর্মকর্তা জানান, জিম্মিদের নিয়ে দরকষাকষিতে সময় দেওয়ার জন্য স্থল আক্রমণ আরম্ভ করতে দেরি করেছিল ইউসরায়েল। কিন্তু আলোচনা থেমে যাওয়ার পর আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল। দেশটি ভেবেছিল, সামরিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে হামাস।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকস্মিক হত্যা চালিয়ে ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে হামাস। পাশাপাশি ২৪০ জনের মতো ইসরায়েলিকে জিম্মিও করে নিয়ে যায় গাজায়।
জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় লাগাতার হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এতে প্রাণ হারিয়েছে ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে কয়েক কয়েক হাজার শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, 'জিম্মি ও নিখোঁজদের ফিরিয়ে আনার আগপর্যন্ত [যুদ্ধে] কোনো বিরতি হবে না। জিম্মিদের রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসরায়েল যদি স্থল অভিযান অব্যাহত রাখে।'
হামাস নেতারা দাবি করেছেন, সব জিম্মি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই; কেননা ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি ইসলামী জিহাদের মতো আরও বেশ কিছু সংগঠন ইসরায়েলে প্রবেশ করে নিজেদের মতো করে জিম্মি নিয়ে এসেছে।
এখন পর্যন্ত আলোচনায় মূলত বেসামরিক জিম্মিদের মুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। গাজায় আটক ইসরায়েলি সেনাদের জন্য আলাদাভাবে আলোচনা করা হতে পারে। সেনাদের ছাড়িয়ে আনার বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারগুলোতে থাকা কয়েকশ ফিলিস্তিনি নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ককে মুক্তি দিতে হতে পারে।
জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে এই আলোচনা হচ্ছিল কাতারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে হামাসকে বার্তা দেওয়ার জন্য কাতারকে ব্যবহার করে আসছে।
কাতারের রাজধানী দোহা এখন জিম্মিদের মুক্তিবিষয়ক আলোচনা এবং গাজায় সহায়তা ঢুকতে দেওয়া নিয়ে আলোচনার মূল কেন্দ্র। গত সপ্তাহে বেসামরিক জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য একটি নতুন শর্ত দিয়েছে হামাস—গাজা উপত্যকায় বন্ধ হতে বসা হাসপাতালগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে।
বেসামরিকদের জন্য দেওয়া জ্বালানি হামাস রকেট আক্রমণে ব্যবহার করে, এমন দাবি করে গাজায় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় সবচেয়ে বেশি দরকারি পণ্যের একটি হলো জ্বালানি। হাসপাতাল থেকে শুরু করে বেকারি চালু রাখার জন্য জ্বালানি প্রয়োজন।
কিন্তু লজিস্টিক্যাল সমস্যা এবং ইসরায়েল ও হামাস দুপক্ষের কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার কারণেই সম্ভবত জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
গাজার হামাসের সামরিক নেতাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে সমস্যা হচ্ছিল কাতারের হামাস নেতাদের। অন্যদিকে হামাসের রাজনৈতিক নেতাদের কোনো চুক্তি করার এখতিয়ার আছে কি না, তা নিয়ে ইসরায়েলিরা সন্দিহান বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
যদিও দোহায় থাকা হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমায়েল হানিয়া এবং গাজার নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার দুজনে যোগাযোগ করেই অক্টোবরে চারজন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এ থেকে তাদের সম্মিলিত চুক্তি করার সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কিন্তু, ওই কর্মকর্তাদের মতে, মূল সমস্যা হচ্ছে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বেশ অসংলগ্ন ও অনিয়মিত। হামাস নেতারা কাতার ও গাজার মধ্যে দ্রুত এবং নিয়মিত যোগাযোগ করতে বেশ ঝামেলা পোহাচ্ছিলেন। তার ওপরে ইসরায়েল স্থল আক্রমণ শুরু করার পর গাজায় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়ায় দোহা ও গাজার নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে।
আর ২৭ অক্টোবর যখন ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হয়, ততদিনে দুপক্ষ চুক্তি করতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় টাইমিংয়ে।
হামাস বলে, সব জিম্মিকে একত্র করতে তাদের পাঁচ দিন সময় লাগবে। কিন্তু ইসরায়েল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাজটি সারতে জোরাজুরি শুরু করে। এছাড়া একেবারে শেষ মুহূর্তে ইসরায়েল দাবি করে বসে, যাদেরকে মুক্তি দেওয়া হবে, তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে হবে। এ আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত দুজন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, এগুলোই চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার মূল কারণ। গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণের মধ্যে তাদের দাবি মেটানো ভীষণ দুরূহ ছিল।
স্থল আক্রমণ শুরুর পর কিছুদিনের বন্ধ থাকার পর ফের আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু লজিস্টিক্যাল সমস্যাটি তখনও আলোচনায় প্রাধান্য বিস্তার করে।
সব বন্দির ওপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ না থাকার ব্যাপারটি স্থল আক্রমণ শুরু হওয়ার পর আরও তীব্র হয়। এতে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাছাই করা জিম্মিদের একত্র করে নিরাপদে ইসরায়েলে পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এছাড়া ইসরায়েলের কারাগার থেকে কোনো ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি পেতে না দেখে এত বেশি জিম্মিকে গাজার হামাস নেতারা ছাড়বেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বলে জানান একজন কর্মকর্তা। ৭ অক্টোবরের হামলার পর হামাস কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার বলেছেন, তাদের আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলে বন্দি প্রায় ৬ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনিদের অনেককে মুক্ত করা।
কাতারের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জিম্মিদের নিয়ে আলোচনার জন্য স্থল আক্রমণের আগে মোসাদ প্রধান ডেভিড বার্নিয়াকে পাঠায় ইসরায়েল। অ্যাক্সিওস-এ তার এই সফরের খবর আসে সবার আগে। সংবাদমাধ্যমটি বলে, ইসরায়েল আক্রমণ শুরুর পর তিনি কাতার সফর করেন।
তবে দুজন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, স্থল অভিযান আরম্ভের আগেই কাতার সফর করেন বার্নিয়া। চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য দ্বিতীয় দফায় দেশটিতে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তার সফর বাতিল হয়ে যায় বলে জানান তারা। এর কয়েকদিন পর তিনি দ্বিতীয়বার দেশটি সফর করে—উদ্দেশ্য, আলোচনা নিয়ে যে ইসরায়েল সিরিয়াস, তা বোঝানো।
আলোচনার প্রাথমিক ধাপে হামাস আরেকটি দাবি তোলে—গাজা উপত্যকায় সহায়তা ঢুকতে দেওয়া এবং বিনা অভিযোগে আটক নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের মুক্তি দেওয়া। বহু শিশু ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতি পাথর ছোড়ার মতো তুচ্ছ সব অপরাধের দায়ে ইসরায়েলে আটক রয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েল এ দাবি নাকচ করে দেয়। হামাস তখন বিমান হামলায় বিরতি দেওয়ার দাবিতে ফিরে যায়।
হামাস এখন তাদের দাবিতে গাজার হাসপাতালগুলোর জন্য কিছু ত্রাণের দাবি যুক্ত করার চেষ্টায় রত। উপত্যকার হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। গাজার প্রায় অর্ধেক হাসপাতালই ইসরায়েলের হামলার শিকার হয়ে অথবা জ্বালানি ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেসব হাসপাতাল এখনও চালু আছে, তারাও বিদ্যুতের অভাবে পূর্ণ কার্যক্রম চালাতে পারছে না বলে জানিয়েছে। অনেক চিকিৎসক মোবাইলফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে সার্জারি করছেন।
গাজার চিকিৎসা সামগ্রী ফুরিয়ে আসছে। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার ও অঙ্গচ্ছেদের মতো বড় সার্জারিগুলো অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই করতে হচ্ছে।
গাজায় সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়ার বিনিময়ে বড় পরিসরে জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি আছে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে ২০ অক্টোবর দুজন মার্কিন এবং এর দুদিন পর দুই ইসরায়েলি নারীকে মুক্তি দিয়েছে হামাস।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শীর্ষ উপদেষ্টা রন ডার্মার গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছেন, হামাসের ছেড়ে দেওয়া জিম্মিদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে গাজার কিছু এলাকায় সামরিক অভিযানে দুবার সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু সেটি জিম্মিদের নিরাপদে বের করে আনার জন্য সাময়িক বিরতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করার লক্ষ্য থেকে ইসরায়েল সরে আসবে না।