‘আমার এই ফ্যামিলি ফটোর বেশিরভাগ শিশুই আর বেঁচে নেই’
চার বছর আগে আহমেদ আল-নাওক যখন তার পরিবারের সঙ্গে এই সেলফি তুলেছিলেন, সেটি ছিল এক অলস, রৌদ্রোজ্জ্বল শুক্রবারের বিকেল। সেই দিনটির কথা খুব ভালোভাবে মনে আছে তাঁর। বিশেষ করে দিনটির কথা এখন তাঁর আরো বেশি করে মনে পড়ছে।
বাড়ির পাশে জলপাই গাছের ছায়ায় তারা ভাইবোন ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে খেতে, খেলতে এবং গল্প করতে জড়ো হয়েছিলেন। সবাই মিলে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি আর হই-হুল্লোড়ের পর আহমেদ বাচ্চাদেরসহ সবাইকে নিয়ে খেতে বসেন।
আহমেদের কাছে এসব এখন শুধুই স্মৃতি। কারণ যাদের ঘিরে এত আনন্দ, এত উপলক্ষ, তাদের অনেকেই আর বেঁচে নেই। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গত ২২ অক্টোবর আহমেদের বাবা, তিন বোন, দুই ভাই ও ১৪ শিশুসহ পরিবারের ২১ জন সদস্য নিহত হয়েছে।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এ হামলার পেছনে ইসরায়েলের যুক্তি হলো, তারা এ অঞ্চল থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়।
আহমেদের ছবিতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুদের মধ্যে মাত্র সাতজনকে দেখা যাচ্ছে। নিহত অন্য শিশুদের কেউ কেউ সেদিন সেখানে ছিল না, কারো আবার তখন জন্মই হয়নি। অনেক ফিলিস্তিনির মতো আহমেদের ভাইয়েরাও পরিবার নিয়ে একই বাড়িতে থাকতেন।
ইসরায়েলি বোমা হামলায় ঘরবাড়ি হারিয়ে আহমেদের বোন আয়া তার বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার অন্য দুই বোন ওয়ালা ও আলাও সন্তানদের নিয়ে ওই বাড়িতে ছিলেন। তাদের বাড়িটি ছিল গাজার কেন্দ্র দেইর আল-বালাহ শহরে। এই এলাকায় এর আগে কখনও হামলা হয়নি। তাই তারা এলাকাটিকে নিরাপদ ভেবেছিলেন।
আহমেদ বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম এটি ওদের জন্য একটি ভীতিকর সময়। ভয় পেলেও ওরা অন্তত সুরক্ষিত থাকবে।' আহমেদ নিজের এই নির্বুদ্ধিতায় এখন হতবাক।
চার বছর আগে একটি এনজিওতে কাজ করার জন্য আহমেদ লন্ডনে চলে যান। শেষবার তিনি ভিডিও কলে শিশুদের একসঙ্গে দেখেছিলেন। তখন তিনি পরিবারের প্রথা অনুযায়ী ওদের দারুণ কিছু খাওয়ানোর কথা বলেছিলেন।
শিশুরা আহমেদকে জানিয়েছিল, ওরা সমুদ্র সৈকত দেখতে যেতে চায়, একটি সুন্দর মনোরম কুটির ভাড়া নিতে চায়। এরপর তারা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, গল্প, আনন্দ করে উপভোগ্য সময় কাটাতে চায়।
শিশুদের কথামতো আহমেদ একটি কুটির ভাড়া করে দিয়েছিলেন, সবার জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
শিশুরা সেদিন সৈকত থেকে আহমেদকে ফোন করেছিল, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করেছিল। ওদের অনেকেই এখন আর পৃথিবীতে নেই।
আহমেদের ১৩ বছর বয়সী ভাগ্নে এসলাম ছিল সবার বড়। এসলামকেই আহমেদ সবচেয়ে বেশি চেনেন। কারণ যখন এসলামের জন্ম হয়, আহমেদ তখন কিশোর ছিলেন এবং বাড়িতেই থাকতেন। তার বোন কর্মস্থলে গেলে তার মা এসলামের দেখাশোনা করতেন। আহমেদ প্রায়শই শিশুটিকে খাওয়াতে এবং কাপড়চোপড় পরিয়ে দিতে সাহায্য করতেন।
এসলাম বড় হয়ে আহমেদের মতো হতে চেয়েছিল। সে ছিল তার ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী।
ইসরায়েলি বোমা হামলায় এসলামের ছোট বোন দিমা (১০), তালা (৯), নুর (৫) এবং নাসমা (২), মামাত ভাই রাগাদ (১৩), বকর (১১), সারা (৯), মোহাম্মদ (৮), খালাত ভাইবোন বাসেমা (৮), আবদুল্লাহ (৬) ও তামিমসহ (৬) পরিবারের অন্য সদস্যরা নিহত হয়েছে।
হামলার পর আহমেদ অনলাইনে প্রতিটি শিশুর ছবি পোস্ট করেন, যাতে এসব শিশুর সঙ্গে কী ঘটেছে, তা পুরো বিশ্বকে জানানো যায়। বাড়িতে যখন হামলা হয় তখন আহমেদের ভাতিজা ওমর (৩), তার বাবা মুহাম্মাদ ও মা সীমার সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল।
আহমেদের এক বোন ফোন করে জানান, ওমর ও সীমা বেঁচে আছে। আহমেদের ভাই মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন।
আহমেদ জানান, অনেক দুঃখের মধ্যেও এই খবরটি তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের একটি মুহূর্ত ছিল।
ইসরায়েলি হামলায় শিশু মালাককে (১১) ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশুটির শরীরের অর্ধেকের বেশি পুড়ে যায়। কয়েকদিন পর সে-ও মারা যায়।
যখন হামলা হয়, তখন মালাকের বাবা বাড়িতে ছিলেন না। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু তার অন্য দুই সন্তান নিহত হয়েছে।
আহমেদ যখন তার কাছে জানতে চাইলেন তিনি কেমন আছেন, মালাকের বাবা উত্তর দিয়েছিলেন: 'একটি শরীর, কোনো আত্মা নেই।'
হামলার এক সপ্তাহ পর গাজার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ কারণে আহমেদ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। দুই দিন পর আহমেদ যখন যোগাযোগ করতে পারেন, তখন জানতে পারেন মালাকও মারা গেছে।
মালাকের বাবা আহমেদকে বলেছিলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল। আরো গুরুতর রোগী আসায় মালাককে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছিল। সে অনেক কষ্ট পাচ্ছিল।
সন্তানদের চোখের সামনে মরতে দেখার পর জীবিত থেকেও যেন মৃত মালাকের বাবা। তিনি বলেন, 'আমি প্রতিদিন শতবার মরছি।'
উল্লেখ্য, গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ১১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।