চ্যাটজিপিটির পেছনে রয়েছে কেনিয়ার শোষিত কর্মীদের শ্রম, ঘণ্টায় ২ ডলার ছিল পারিশ্রমিক
গতবছর বিশ্ব প্রযুক্তি খাতের অন্যতম উদ্ভাবন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ওপেন এআই চ্যাটবট প্ল্যাটফর্ম চ্যাটজিপিটি। খুবই শক্তিশালী এ চ্যাটবটটি যেকোনো বিষয়ের ওপর অনায়াসেই লাইনের পর লাইন লিখে ফেলতে পারে। এমনকি শেক্সপিয়ারের সনেটকে পরিবর্তন করে মেগান থি স্তালিয়নের মত করে লেখা কিংবা জটিল সব গাণিতিক তত্ত্বকে পাঁচ বছরের শিশুর বোধগম্য হিসেবে তুলে ধরার মত অচিন্তনীয় কাজগুলো সহজেই করছে চ্যাটজিপিটি। গত বছরে নভেম্বরে মুক্তির পর থেকে প্ল্যাটফর্মটি এক সপ্তাহের মাঝেই মিলিয়ন সংখ্যক ব্যবহারকারী লাভ করে।
বর্তমানে চ্যাটজিপিটির প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানি ওপেন এআই প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ফান্ড গঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই টেক জায়ান্ট কোম্পানি মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে আরও ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। এতে করে সুদূর ভবিষ্যতে ২০১৫ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানিটি এআই জগতের অন্যতম মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
তবে চ্যাটজিপিটির এ সফলতার পেছনে একক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবদান আছে বলে ভাবলে ভুল হবে। বরং বহু কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের অজস্র শ্রমের বিনিময়ে আজকের এই এআই প্ল্যাটফর্মটি অবাক করার মত সন্নিবেশিত তথ্য দিতে সমর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি গণমাধ্যম টাইম এর এক তদন্তে দেখা যায়, ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মটির উন্নতকরণে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র দুই ডলারের বিনিময়ে কেনিয়ান কর্মীরা কাজ করেছেন!
চ্যাটজিপিটির পূর্বসূরি হিসেবে খ্যাত জিপিটি-৩ একাধিক বাক্যকে যুক্ত করে অর্থবহ ফলাফল দিতে পারতো। কিন্তু সেটি গ্রাহক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মটিকে বেশ জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কেননা প্লাটফর্মটি সহিংস, বর্ণবাদী ও যৌন সহিংসতামূলক তথ্যের মুখোমুখি হতে থাকে।
এআই প্ল্যাটফর্মটি মূলত ইন্টারনেটে বিদ্যমান অজস্ত্র তথ্যকে ইনপুট হিসেবে নিয়ে সন্নিবেশিত করে তৈরি করা হয়েছে। ইন্টারনেটে থাকা বিপুল পরিমাণ তথ্যকে এআই প্ল্যাটফর্মটিতে নেওয়া হয়েছে বিধায় এটি চমৎকার সব ফলাফল দিতে পারে। তবে ইন্টারনেটে বিদ্যমান অজস্ত্র তথ্যের অনেকগুলোই বেশ পক্ষপাতদুষ্ট। আবার অনেক তথ্যই সহিংস ও কুরুচিপূর্ণ। তাই বিপুল পরিমাণ তথ্য ভাণ্ডার থেকে এ পক্ষপাতদুষ্ট ও সহিংস তথ্যগুলোকে সরানো খুবই প্রয়োজন ছিল।
একটি একটি করে এসব পক্ষপাতদুষ্ট ও সহিংস তথ্যগুলোকে সরাতে গেলে হাজার হাজার কর্মীর বহু বছর লেগে যেত। তাই ওপেন এআই প্লাটফর্মটির জন্য এআই চালিত একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রযুক্তি তৈরির পরিকল্পনা করে। অতিরিক্ত এ নিরাপত্তা প্রযুক্তিটি মূলত ক্ষতিকারক তথ্যগুলোকে প্রোগ্রাম অনুযায়ী শনাক্ত করে সরিয়ে দিয়ে চ্যাটবটটিকে প্রতিদিনের ব্যবহারের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে।
এমন নিরাপত্তা প্রযুক্তি তৈরি করতে ওপেন এআই ফেসবুকের মত বড় প্রযুক্তি জায়ান্ট কোম্পানির গৃহীত কৌশলের দিকে অগ্রসর হয়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে ফেসবুক শক্তিশালী এআই ফিল্টারিং প্রযুক্তি তৈরি করেছে যা কি-না সহিংস বক্তব্যগুলো শনাক্ত করে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলে।
ফিল্টারিং এর পদ্ধতিটি খুব বেশি জটিল নয়। কেননা একটি এআই প্রযুক্তি তৈরি করে সেটিতে সহিংসতা, ঘৃণাসূচক বক্তব্য, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদির নানা উদাহরণ নমুনা হিসেবে ইনপুট করলে ঐ এআই তা পর্যালোচনা করে এবং পরবর্তীতে অনুরূপ তথ্য শনাক্ত করতে পারে। ঠিক এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করেই ট্রেনিং ডাটাসেট থেকে এসব তথ্য বাদ দিয়ে ওপেন এআই ব্যবহারকারীদের কাছে প্ল্যাটফর্মটি অবমুক্ত করার নীতি গ্রহণ করে।
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে ২০২১ সালের নভেম্বরের দিকে ওপেন এআই হাজার হাজার খণ্ডিত টেক্সট কেনিয়ার কর্মীদের একটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রেরণ করতে থাকে। প্রেরণকৃত টেক্সটের বেশিরভাগই ইন্টারনেটের বিতর্কিত জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। কিছু কিছু টেক্সট এমন যে, সেখানে শিশুদের যৌন সহিংসতা, খুন, সুইসাইড ও নির্যাতনের মত ঘটনার বর্ণনা ছিল।
কেনিয়াতে ওপেন এআই এর আউটসোর্সিং পার্টনার ছিল 'সামা' নামের এক কোম্পানি। সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক এ কোম্পানিটি কেনিয়া, উগান্ডা ও ভারতের মত দেশগুলো থেকে গুগল, মেটা ও মাইক্রোসফটের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়ে ডেটা লেবেলের কাজে কর্মীর সংস্থান করে থাকে। কোম্পানি সামা মূলত একটি 'এথিক্যাল এআই' কোম্পানি যেটি প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে দরিদ্রসীমা থেকে উত্তোলনের দাবি করে থাকে।
কেনিয়ায় কোম্পানি সামা এ কর্মরত কর্মীরা অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতার ভিত্তিতে মূলত ঘণ্টায় ১.৩২ ডলার থেকে ২ ডলারের মজুরীতে ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মের জন্য কাজ করতেন। সম্প্রতি টাইম এর পক্ষ থেকে ওপেন এআই ও কোম্পানি সামা এর মধ্যকার চুক্তি সংশ্লিষ্ট শত শত পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করেছে। এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির চারজন কর্মী টাইমকে এ কাজ সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
তবে ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মকে নিরাপদ ও উপযোগী করে গড়ে তুলতে কেনিয়ার যে কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করেছেন তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ওপেন এআই কোম্পানিগুলোর বৈশ্বিক জোট 'পার্টনারশিপ অন এআই' এর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে বলা হয়, "নানা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা যায়, ডাটা সমৃদ্ধকরণে কাজ করে যাওয়া এসব কর্মীরা কতটা নিরাপত্তাহীন কর্মক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যকারিতা যে বিপুল সংখ্যক কর্মীর ওপর নির্ভর করে সেটি লুকানোর প্রবণতা থেকেই মূলত এটির সৃষ্টি। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল!"
এমনকি ওপেন এআই ঠিক কোন কোন আউটসোর্সিং কোম্পানির সাথে কাজ করে সে তথ্যও খোলাসা করে না। তাই এও হতে পারে, কোম্পানি সামা ছাড়াও অন্য আরও কোম্পানির সাথে ওপেন এআই কাজ করে থাকে। একটি বিবৃতির মাধ্যমে সম্প্রতি ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মের একজন মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, চ্যাটজিপিটিকে নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে সামা কোম্পানি কর্মীরা কাজ করেছেন।
ওপেন এআই এর বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "চ্যাটজিপিটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবতার কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করা। সে উদ্দেশ্যে আমরা পক্ষপাতদুষ্ট ও ক্ষতিকারক কন্টেন্টের পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সহিংস ও যৌন নিপীড়নমূলক কন্টেন্টের পরিমাণ কমিয়ে আনতে ক্ষতিকারক টেক্সট ও ছবি শনাক্ত এবং ফিল্টারিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।"
বৈশ্বিক সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যেখানে বড় বড় প্রযুক্তি জায়ান্ট কোম্পানি উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেখানে এআই কোম্পানিগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসছে। আর ভবিষ্যতের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টরটির নেতৃত্বে আছে ওপেন এআই। কম্পিউটার জেনারেটেড টেক্সট, ভিডিও, ছবি ও অডিও বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। কিন্তু ওপেন এআই এর চাকচিক্যময়তার ভিড়ে লুকিয়ে আছে ডাটা লেবেল কর্মীদের শোষণের গল্প।
ওপেন এআই বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে রূপ নিলেও পর্দার আড়ালে কাজ করে যাওয়া কেনিয়ার এসব কর্মীদের জীবনে ইতিবাচক কোন পরিবর্তন আসেনি। ওপেন এআই এর জন্য কোম্পানি সামা এর হয়ে কাজ করা এক কর্মী সাক্ষাৎকারে জানান, যৌন সহিংসতামূলক কন্টেন্ট দেখে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।
ঐ কর্মী বলেন, "সপ্তাহজুড়ে একের পর এক ডিস্টার্বিং কন্টেন্ট দেখতে হত। শেষমেশ যখন শুক্রবার আসতো, তখন চিন্তার জগতে সেগুলোই ঘুরপাক খেতে থাকতো।" কাজটির এ নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সামা কোম্পানি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওপেন এআই এর হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
ওপেন এআই প্ল্যাটফর্মের সাথে সামা কোম্পানির চুক্তি টাইম কর্তৃক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানি দুটির মধ্যে মূলত দুই লাখ ডলারের মোট তিনটি চুক্তি হয়েছিল। যৌন নিপীড়ন, সহিংসতা ও ঘৃণামূলক বক্তব্যকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে উক্ত বিষয়াবলীকে টেক্সটের মাধ্যমে বর্ণনা দিতে ২০২১ সালে এ চুক্তিটি করা হয়। প্রায় তিন ডজন কর্মকর্তাকে তিন দলে ভাগ করে এ ভিন্ন তিন ক্যাটাগরিতে কাজগুলো করা হয়।
এ দলগুলোতে থাকা তিনজন কর্মী টাইম কে জানান, প্রতিদিন নয় ঘণ্টার করে প্রত্যেককে প্রায় ১৫০ থেকে ২৫০ টি অনুচ্ছেদ পড়ে সেগুলোর ডেটা লেবেল করতে হতো। প্রতিটি অনুচ্ছেদ ১০০ শব্দ থেকে ১ হাজার শব্দ পর্যন্ত হতো। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রতিটি কর্মীকে কাউন্সিলের আওতায় আনা হতো।
কিন্তু টাইম এর পক্ষ থেকে যে চারজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, সে চারজনই কাজটি করতে যেয়ে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ বোধ করেছিল বলে জানান। এছাড়াও কাজে যুক্ত কর্মীদের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখতে শুধু গ্রুপ সেশনের ব্যবস্থা করা হলেও কর্মীদের পক্ষ থেকে 'ওয়ান টু ওয়ান' কাউন্সিলিং সেশন নেওয়ারও অনুরোধ করা হয়। তবে কর্মীদের 'ওয়ান টু ওয়ান' কাউন্সিলিং সেশন করানোর দাবি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নাকচ করা হয় এবং যার ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাউন্সিলগুলো খুব বেশি কার্যকরী হয়নি।
যদিও বিবৃতিতে সামা কোম্পানির পক্ষ থেকে শুধু গ্রুপ সেশন প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। বরং কোম্পানিটির এক মুখপাত্র জানান, কর্মীদের পেশাদার ও নিবন্ধিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দ্বারা গ্রুপ সেশন এবং একইসাথে 'ওয়ান টু ওয়ান' সেশন প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও কর্মীরা যেকোনো সময় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের থেকে সেবা নিতে পারতো বলে জানান তিনি।
চুক্তিতে প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য ওপেন এআই সামা কোম্পানিকে ১২.৫ ডলার প্রদান করতো। চুক্তিতে উল্লেখিত এ মজুরী অপেক্ষা সামা কোম্পানি কর্তৃক কর্মীদের প্রদানকৃত মজুরী প্রায় ৬ থেকে ৯ গুণ কম। ডাটা লেভেলারদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র কর্মীরা মাসে ১৭০ ডলার বেতন পেতেন। এছাড়াও একইসাথে ক্ষেত্রবিশেষে পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে মাসিক বোনাস হিসেবে আরও প্রায় ৭০ ডলার পেতেন।
যার ফলে দিনশেষে একজন কর্মী এ কাজ করে টার্গেটের ওপর ভিত্তি করে ট্যাক্স বাদে ঘণ্টায় ১.৩২ ডলার থেকে ১.৪৪ ডলারের আয় করতেন। অন্যদিকে একজন সিনিয়র ডেটা লেবেল কর্মী প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারলে ঘণ্টায় ২ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারতেন। যদিও কেনিয়াতে ঘণ্টায় সর্বনিন্ম বেতনের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কিন্তু ঠিক একই সময় দেশটির রাজধানী নাইরোবিতে একজন অভ্যর্থনাকারীর সর্বনিন্ম বেতন ছিল ঘণ্টায় ১.৫২ ডলার।
অন্যদিকে বিবৃতিতে সামা কোম্পানির মুখপাত্র কর্মীদের দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ টি অনুচ্ছেদের ডেটা লেভেল করানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। মুখপাত্র জানান, দিনে একজন কর্মী প্রায় ৭০ টি অনুচ্ছেদের ডাটা লেভেল করে থাকতেন। একইসাথে কর্মীরা ট্যাক্স প্রদানের পরেও ঘণ্টায় ১.৪৬ ডলার থেকে ৩.৭৪ ডলার আয় করতে পারতেন।
ওপেন এআই এর কাছ থেকে ঘণ্টায় ১২.৫ ডলার অর্থ নিয়ে এত কম পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বলেন, "ঘণ্টায় ১২.৫ ডলার শুধু কর্মীর বেতনের জন্য নেওয়া হয় না। বরং এতে অবকাঠামোগত ব্যয়, সাধারণ বেতন, সুযোগ-সুবিধা, মান নির্ণায়ক বিশ্লেষকের বেতন ও টিম লিডারদের বেতনসহ নানা খরচ জড়িত।"
অন্যদিকে ওপেন এআই মুখপাত্রের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ওপেন এআই এর পক্ষ থেকে সামা কোম্পানিকে কোন টার্গেট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এমনকি কর্মীদের মানসিক অবসাদের জন্য কোম্পানিটি উল্টো সামা কোম্পানিকে দোষারোপ করে।
ওপেন এআই মুখপাত্র জানান, আমাদের চুক্তিতে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের উপলব্ধি ছিল, সামা কর্তৃপক্ষ কর্মীদের 'ওয়ান টু ওয়ান' কাউন্সিলিং দিচ্ছে। একইসাথে সংবেদনশীল তথ্য বিশ্লেষণের জন্য এ কাজে প্রশিক্ষিত কর্মীরা তা সম্পাদন করছেন।
কেনিয়ার কর্মীদের প্রতিনিয়ত জটিল সব ডাটা লেভেল করতে অনেক সমস্যারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। একবার এক কর্মী একটি যৌন সম্পর্কের ভিডিও পর্যালোচনা করতে যেয়ে খুবই বিড়ম্বনায় পরেন। কেননা ভিডিওতে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না, এতে পরস্পরের সম্মতি আছে কি-না।
ভিডিওটির প্রথমদিকে যদিও মনে হচ্ছিলো যে একজনের সম্মতি নেই। কিন্তু পরবর্তীতে আবার মনে হচ্ছিলো যে, তিনি পরবর্তীতে সম্মতি প্রদান করেছেন। এ বিষয়ে ঐ কর্মী ওপেন এআই এর বিশেষজ্ঞদের কাছে সহয়তা চাইলে বিশেষজ্ঞ দল জানায় যে, ভিডিওর কোন এক পর্যায়ে সম্মতি দিলেই সেটিকে নেতিবাচক কন্টেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই!
তবে ওপেন এআই কোম্পানির সাথে সামা কোম্পানির সম্পর্ক বেশদিন টেকসই হয়নি। কেননা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামা কর্তৃপক্ষ ওপেন এআই এর কাছ থেকে একটি পাইলট প্রজেক্ট হাতে নেয়। এ পাইলট প্রজেক্টে সামা কোম্পানি যৌনতা ও সহিংসতা সম্পর্কিত কিছু ছবি সংগ্রহ করে যার কিছু ছবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী অবৈধ।
একইসাথে সংবেদনশীল এ ছবিগুলোর সাথে চ্যাটজিপটি চ্যাটবটের কোন সংশ্লিষ্টতাও নেই। বিবৃতিতে ওপেন এআই মুখপাত্র ঐ সংবেদনশীল ছবিগুলো লেবেল করার চুক্তির কারণ উল্লেখ না করলেও এআই টুলকে নিরাপদ করতে ক্ষতিকারক ছবির ডাটা লেবেল করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।
টাইম এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ওপেন এআই কর্তৃপক্ষকে সামা কোম্পানি সেনসিটিভ ছবিগুলোর প্রায় ১৪ হাজার স্যাম্পল প্রদান করে। এ ছবিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবি 'সি ৪' ধরণের যেগুলোকে খোদ ওপেন এআই এর পক্ষ থেকে যৌন নিপীড়ন বলে প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রদানকৃত ছবিগুলোর মধ্যে 'সি ৩' ক্যাটাগরির ছবি ছিল যেগুলো ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব ও পাশবিক কন্টেন্টের আওতায় পরে। ডকুমেন্ট অনুযায়ী, এসব কন্টেন্টের জন্য ওপেন এআই কর্তৃপক্ষ সামা কোম্পানিকে সর্বমোট ৭৮৭.৫০ ডলার প্রদান করেছে।
ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই সামা কোম্পানি চুক্তি শেষের ৮ মাস আগে ওপেন এআই এর সাথে কাজ বন্ধ করে দেয়। সামা কর্তৃপক্ষ বিবৃতিতে জানান, ওপেন এআই এর সাথে করা চুক্তিতে প্রথমে অবৈধ কন্টেন্ট সম্পর্কে কোন নির্দেশনা ছিল না। কাজ শুরু করার পরে ওপেন এআই কর্তৃপক্ষ অবৈধ কন্টেন্ট সম্পর্কে একটি অতিরিক্ত নির্দেশনা প্রদান করে।
তখনই কোম্পানিটির পূর্ব আফ্রিকার টিম সামা কোম্পানির নির্বাহীদের কাছে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর সামা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক পাইলট প্রজেক্টটি বন্ধ করে এবং ওপেন এআই এর সাথে সব চুক্তিও বাতিল করে।
অন্যদিকে ওপেন এআই এর পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, "এআই প্ল্যাটফর্মকে নিরাপদ রাখতে আমরা সামা কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করেছিলাম। তবে 'সি ৪' ক্যাটাগরির কন্টেন্ট সংগ্রহের ব্যাপারে এমন কোন নির্দেশনা আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। আমাদের সিস্টেমে ইনপুট হিসেবে এসব কন্টেন্টের প্রয়োজন নেই। সামা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এই ধরণের কন্টেন্ট সংগ্রহের কথা জানানো হলে আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করি। পুরো ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছিল এবং তাই আমরা ঐ কন্টেন্টগুলো আর খুলে দেখিনি। এমনকি আমরা জানিও না যে, সেগুলো আসলেই 'সি ৪' ক্যাটাগরির না-কি।"
ওপেন এআই এর সাথে সামা কর্তৃপক্ষের চুক্তি বাতিলের ফলে কর্মীরা মানসিকভাবে ক্ষতিকারক টেক্সট ও ছবির থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। কিন্তু কাজ হারানোয় তাদের জীবিকার উপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এক কর্মী বলেন, "২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মিটিং ডেকে কোম্পানির পক্ষ থেকে কাজটি বন্ধের কথা জানানো হয়। এরপর তিন ডজনের মত কর্মীদের আরেকটি কম পারিশ্রমিকের কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে মাস শেষে ৭০ ডলারের যে বোনাস পাওয়া যেত, সেটি আর পরবর্তী কাজে পাওয়া যায়নি।"
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় আট মাস পূর্বেই চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সামা কর্তৃপক্ষ দুই লাখ ডলারের পুরো অর্থ পায়নি। ওপেন এআই এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, শেষমেশ মোট দেড় লাখ ডলার প্রদান করা হয়েছে।
ওপেন এআই কর্তৃপক্ষের সাথে সামা কর্তৃপক্ষের চুক্তি বাতিলের আরও একটি কারণও উল্লেখ করেছে টাইম। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাইম কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে ফেসবুকের সেনসিটিভ কন্টেন্ট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ফেসবুক সামা কোম্পানির মাধ্যমে ঘণ্টায় মাত্র দেড় ডলারের বিনিময়ে ধর্ষণ, হত্যা ও শিশু নির্যাতনের মত কন্টেন্টগুলো নিয়ে কাজ করানো হয়। কোম্পানিটি চারজন কর্মী জানান, গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর সামা কোম্পানি সতর্কতামূলক ওপেন এআই এর সাথে চুক্তি থেকেও সরে আসে।
চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সামা কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটি সকল ধরণের সংবেদনশীল কন্টেন্ট নিয়ে করা কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একইসাথে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেসবুকের সাথে ৩.৯ মিলিয়ন ডলারের কন্টেন্ট মডারেশনের চুক্তিটিও আর নবায়ন করবে না। যার ফলে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির আরও ২০০ জন কর্মী নিজেদের চাকরি হারিয়েছে।
সামা কর্তৃপক্ষ চুক্তি বাতিল করলেও এআই সিস্টেমের ডেটা লেবেলের জন্য মানুষের ব্যবহার আজও প্রয়োজনীয়। তাই আবারও ভিন্ন কোন পদ্ধতিতে ও ভিন্ন কোন কোম্পানির মধ্যে দিয়ে একই কাজ যে আবারও করা হবে সেটি অনেকটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ সম্পর্কে এআই নীতি নিয়ে কাজ করা অ্যান্দ্রিও টাইমসকে বলেন, "চ্যাটজিপিটি ও অন্য এআই জেনারেটিভ মডেলগুলো চমৎকার। কিন্তু এ প্লাটফর্মগুলো ব্যাপকভাবে কর্মীনির্ভর। একইসাথে এখানে সম্মতি ছাড়াই বহু তথ্য যুক্ত করা হয়। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। যদিও ওপেন এআই এগুলো স্বীকার করছে না।"
সূত্র: টাইম