বাঙালি নারী—ক্যামেরার সামনে, পেছনে
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয়দের হাত ধরে ছবি তোলার প্রযুক্তি এসেছিল ভারতবর্ষে। প্রথম প্রথম ক্যামেরার সামনে সাধারণ বাঙালির দাঁড়াবার অভিজ্ঞতাও সুখকর কিছু ছিল না। দীর্ঘ এক্সপোজারে ব্যক্তিকে স্থির রাখবার প্রয়োজনে সেকালের আলোকচিত্রীরা বাঙালির মনে নানা অমূলক ভয়ভীতি ঢোকাতে দ্বিধা করেননি। উনিশ শতকের শেষ ভাগ নাগাদ এ অবস্থা অনেকটা কেটে যায়। কখনো একা, কখনো সপরিবারে বাঙালি এসে দাঁড়ায় ক্যামেরার সামনে। অসংখ্য সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে বেশ কজন বাঙালি সেই আদি যুগে ক্যামেরা ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেন, অনেকে ফটোগ্রাফিকে বেছে নেন পেশা হিসেবে। তবে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে উপমহাদেশজুড়ে দীর্ঘকাল ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পুরুষের। রক্ষণশীল সমাজে হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে ক্যামেরার সামনেই যেখানে নারীর উপস্থিতি সীমিত, সেখানে ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ছিল কল্পনাতীত। তবে অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্য—নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বেশ কজন সাহসী নারী। ক্যামেরা নিয়ে বাংলার নারীর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁদের আত্মজীবনী আর স্মৃতিকথায়। ফটোগ্রাফি আগমনের প্রথম এক শত বছরে ক্যামেরার সামনে এবং পেছনে দাঁড়ানোর সেসব কথকতা নিয়ে এই নিবন্ধ।
স্মৃতিটুকু থাক—বাঙালি নারীর ছবি তোলার গল্প
১৩০১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় আলোকচিত্রচর্চার প্রথম বই 'ফটোগ্রাফী শিক্ষা' নামের বইতে লেখক আদিশ্বর ঘটক উল্লেখ করেন, উপমহাদেশে ফটোগ্রাফি পৌঁছাবার কালে একটি প্রতিকৃতি অঙ্কনের জন্য শিল্পীর পারিশ্রমিক ছিল কমপক্ষে ১০০ টাকা। নেহাত উচ্চবিত্ত পৃষ্ঠপোষক ছাড়া সাধারণের পক্ষে প্রতিকৃতি আঁকানো সম্ভব ছিল না। লেখক, সাংবাদিক এবং কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অন্যতম নেতা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দূতীবিলাস' থেকে—'সহরের বড় মানুষদের আপন আপন খোস চেহারার ছবি আঁকানো, এটি তাদের উঁচু সমাজের ফেসন। কিন্তু বিচক্ষণ চিত্রকরেরা হুজুরদের ছবি আঁকতে এতটুকো যত্ন বা শ্রম করে না, বাবুর ভাগ্যে আর তাদের হাতযশে যা বার হয় সেইগুলিই পোরট্রেট নামে বিখ্যাত হয়ে বাবার বৈঠকখানা ঘর শোভিত করে।' তবে বিত্তশালী লোকেদের বসার ঘরে সাজানো সেসব প্রতিকৃতির মাঝে নারীমুখ খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। এসবের অধিকাংশ ছিল নিজেদের অথবা নিজ পিতা বা পিতামহের, যেখানে তাঁরা দাঁড়িয়েছেন নবাবি কিংবা ইংরেজ সাজ পোশাকে। দেয়ালে যে একেবারে কোনো নারীর প্রতিকৃতি ছিল না, তা বললে ভুল হবে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেয়ালজুড়ে থাকত পশ্চিমা রূপসীরা। বাড়ির মহিলাদের মধ্যে প্রথম যারা দেয়ালে ঠাঁই পেলেন, তারা হলেন কর্তার মা, ঠাকুরমা প্রমুখ। জপমালা হাতে বসা মায়ের ছবি আঁকিয়েছেন অনেক কর্তাব্যক্তি। এ তো গেল শিল্পীর আঁকা প্রতিকৃতির কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে বাঙালি নারী প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বিবাহসূত্রে। উনিশ শতকের শেষে বিবাহের পর স্বামীর সাথে স্টুডিও গিয়ে একটি ফর্মাল ছবি তুলবার রেওয়াজ গড়ে ওঠে। অধিকাংশ নারীর জন্য সেটাই ছিল প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার অভিজ্ঞতা। নিজ আয়নার বাইরে অমন বাঁধাই করা প্রতিকৃতি বাঙালি নারী হৃদয়ে খানিকটা হলেও স্বাধীনতার সুখ এনে দিয়েছিল। তত দিনে অবস্থাপন্ন ও কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারে নারীর একক ছবি তোলার চর্চা শুরু হয়। উদাহরণ হিসেবে ঢাকার নওয়াব পরিবারের কথা উল্লেখ করা যায়, সেখানে পরিবারের নারী সদস্যদের বেশ কিছু একক ছবি পাওয়া যায়। কলকাতার ধনাঢ্য পরিবারগুলোতেও নারীদের এমন বেশ কিছু একক ছবির দেখা মেলে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর কিশোরী কালের একটি ছবি পাওয়া যায়, যা তুলেছিল সেকালের বিখ্যাত স্টুডিও 'জন্সটন এন্ড হফম্যান'। মধ্যবিত্ত সমাজে নারীর একক ছবি তোলার বহুল প্রচলন হয় বিবাহের পাত্র-পাত্রী দেখবার সূত্রে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের স্টুডিওতে যাতায়াতের সুযোগ ছিল কম। বিবাহ উপযুক্ত নারীর ছবি তোলার প্রয়োজনে আলোকচিত্রী বাড়িতে ডেকে আনার চল ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প হৈমন্তী থেকে অপুর বয়ানে—
'বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো—একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া। কোনো একজন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া, খোঁপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া, বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি। কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা, সে আমি বলিতে পারি না। যেমন তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাটা শতরঞ্চ ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা।'
লেখিকা ইলা মজুমদার তখন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী। তাঁর স্মৃতিকথায়, 'হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা দাদু এসে নামলেন রিকশা থেকে, সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফার। ধীর পায়ে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, আজ ছবি তুলতে হবে। তুমি হবে স্বর্গের অপ্সরী, আর আমি তোমার সুরে আত্মহারা এক ভক্ত। তাঁর নির্দেশে মাঝের আঙিনায় শতরঞ্চি বিছিয়ে সেজেগুজে চুল এলো করে তানপুরো ধরে বসলাম, আর দাদু তাঁর পাঞ্জাবিটা খুলে নগ্ন দেহে মগ্ন চিত্তে আমার গান শুনছেন—এমন একটা ভঙ্গিতে ছবি তোলালেন।'
মুসলিম পরিবারে নারীর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার নজির সেকালে বিরল। ১৯২৯ সালের কথা। 'সওগাত' সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিলেন 'সওগাত'-এর একটি মহিলা সংখ্যা প্রকাশ করবেন, যেখানে লেখিকাদের ছবিসহ লেখা থাকবে। সেকালে মুসলিম মহিলার ছবি তোলার উদাহরণ বিরল। কবি সুফিয়া এন হোসেনের (পরবর্তীকালে বেগম সুফিয়া কামাল) সওগাতের লেখা থাকবে, কিন্তু তাঁর ছবি কই? তিনি ক্যামেরার সামনে কখনো দাঁড়াননি। এক বিকেলে জনাব নাসিরউদ্দীন বেগম সুফিয়াকে নিয়ে গেলেন আলবার্ঠলের তিনতলায়, চারু গুহর স্টুডিওতে। চারুর জন্ম ঢাকায়। ঢাকায় সুবিধা করতে না পেরে কলকাতায় স্টুডিও ব্যবসা চালু করেন। জনাব নাসিরউদ্দীনকে চারু জানান যে এ পর্যন্ত তিনি কোনো মুসলিম মহিলার ছবি তোলেননি। এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে জনাব নাসিরুদ্দীনকে সতর্কও করেন চারু। কিন্তু নাসিরুদ্দীন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। প্রথম এক মুসলিম মহিলা কবির ছবি তোলার কোনো পারিশ্রমিক নেননি চারু। ছবিগুলো সযত্নে পাঠিয়ে দেন 'সওগাত' অফিসে। চারুর তোলা সেই ছবিসহ প্রথম মহিলা সংখ্যা 'সওগাত' প্রকাশ পায় সে বছরের সেপ্টেম্বরে। এই সংখ্যা প্রকাশের পর অনেক মুসলিম লেখিকা তাঁদের ছবি পত্রিকায় ছাপাতে সম্মত হন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মুসলিম পরিবারে বাইরের থেকে ফটোগ্রাফারের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজ পরিবারের অল্পস্বল্প ফটোগ্রাফি জানা আত্মীয়র ক্যামেরায় ছবি তোলার কাজ সারতেন। লেখিকা রাবেয়া খাতুন তখন ঢাকার শান্তিনগর নিবাসী। 'বেগম পত্রিকার জন্য লেখা ঠিক করে পাঠাতে চাইলেন। তখন বেগম পত্রিকায় লেখার সাথে লেখিকার ছবি ছাপানো হতো। রাবেয়া খাতুনের স্মৃতি থেকে—গল্প যাওয়া মানেই ছবি যাওয়া। কিন্তু লেখা না হয় খেটেখুটে তৈরি করলাম, ছবি? ওরা পাসপোর্ট সাইজের ফটোগ্রাফের কথা বলেন। অমন একটি পাই কোথায়? ছোট একটি অ্যালবাম ছিল। কিন্তু পারিবারিক ছবি। একার কই? সারা তল্লাটে স্টুডিওর অস্তিত্ব নেই। থাকলেও ঘর থেকে বাইরে ছবি তোলা সম্ভব না। আমাদের সব ছবি তুলতেন আমার কাজিন বড় ভাই। পেশায় ডাক্তার, নেশা ছবি তোলা। তিনি তখন ঢাকার বাইরে পোস্টিংয়ে। কি করি?... তখনকার একমাত্র পারিবারিক উৎসাহদাত্রী ছোট বোন সুফিয়া। ওর সঙ্গে পরামর্শ করে ভাইবোনের সঙ্গে তোলা একটি ছবি থেকে আমার অংশটুকু কাচিকাটা করে গল্পের সঙ্গে পাঠালাম।'
পারিবারিক চর্চায় ছবি তোলা
পূর্ব বাংলার রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে ছবি তোলার পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছে ঢাকা নওয়াব পরিবার। নওয়াব আহসানউল্লাহর ক্যামেরাপ্রীতি ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর সেই আগ্রহ বংশপরম্পরায় ছড়িয়েছিল পুত্র নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এবং অন্য সদস্যদের মাঝে। ঢাকার নওয়াব পরিবারের বিপুলসংখ্যক ছবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এবং এর একটি বড় অংশজুড়ে পরিবারের মহিলাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। নারী সদস্যদের ছবিগুলো বিশ শতকে তোলা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নওয়াব আহসানউল্লাহর কন্যা মেহেরবানু খানম, আহসানউল্লাহর আরেক কন্যা বিলকিস বানুর মেয়ে আলমাসী বানু, অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান স্নাতকদের অন্যতম জুলেখা বানু (নওয়াব আহসানউল্লাহর কন্যা পরী বানুর মেয়ে), নওয়াব সলিমুল্লাহর শেষ স্ত্রী আজিজুন্নেসা, খাজা আতিকুল্লাহর মেয়ে ফরহাত বানু, নওয়াব হাবিবুল্লাহর স্ত্রী আজমেরী বেগম প্রমুখের ছবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম রূপকার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী নিজে এবং তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের অনেকে ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন। তাঁর সেসব ছবি তুলেছিল কলকাতার 'বোর্ন এন্ড শেফার্ড' এবং ঢাকার 'বেঙ্গল স্টুডিও'। সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের একাধিক ফটো বিভিন্ন প্রকাশনায় ছাপা হয়েছে। মীর মশাররফের দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমের একটি ফটো পাওয়া গিয়েছে, যা ১৯১০ সালের আগে তোলা।
'সওগাত' সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের বড় প্রিয় বিষয় ছিল ক্যামেরা। তিনি নিজে এককভাবে কিংবা পরিবারসহ যেমন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন তেমনি 'মহিলা সওগাত' এবং 'বেগম' পত্রিকার সূত্রে বহু লেখিকাকে ছবি তোলায় উদ্বুুদ্ধ করেছেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন ক্যামেরাপ্রিয় মানুষ। কর্মজীবনে তাঁর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেছেন ডব্লিউ এ খান।
ছবি তোলার প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল হওয়ায় একক ছবির তুলনায় গ্রুপ ছবি তোলা হতো বেশি। স্টুডিও থেকে আলোকচিত্রী ডাকিয়ে এনে তোলা সেসব ছবিতে নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যকে ঘিরে গ্রুপ ছবি তোলাবার রীতি চালু হয়েছিল বাঙালির ঘরে ঘরে। দেশভাগের পর হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে অনেক পরিবারের কর্তারা নিজ স্ত্রী, সন্তানসহ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন।
উনিশ শতকের শেষ দশকে শৌখিন আলোকচিত্রীদের জন্য কোডাক ক্যামেরা নতুন যুগের সূচনা করে বললে অত্যুক্তি হবে না। 'You press the button, We do the rest'—জর্জ ইস্টম্যানের এই ঘোষণায় ছবি তোলার জটিলতা নিয়ে ভয়ভীতি অনেকটা কেটে গিয়েছিল। গ্লাস-প্লেটের পরিবর্তে ফিল্ম ব্যবহার করায় এর আকার ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট, চামড়ায় মোড়ানো কাঠের বাক্সটি বহন ছিল সহজযোগ্য। সে সময়ে ভারতের পত্রপত্রিকাজুড়ে কোডাকের নিয়মিত সচিত্র বিজ্ঞাপনের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। একটি বিজ্ঞাপনে ভারতবর্ষে বসবাসরত ইংরেজদের চিঠি লেখার ঝামেলায় না গিয়ে কোডাকে স্ন্যাপশট নিতে আহ্বান করা হয়, কারণ ফটোর বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি, তাদের তোলা কোডাক ফটো বিলাতের মানুষকে ভারত বিষয়ে সঠিকভাবে জানতে সাহায্য করবে। বাঙালিদের কোডাক ক্যামেরার প্রতি আকৃষ্ট করবার জন্য এক বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছিল ঢাকার দুর্গামোহন দাসের কন্যা সরলা দাস এবং তার স্বামী ড. প্রসন্ন কুমার রায়ের যুগল ছবি। প্রসন্ন কুমার রায় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ। কোডাক ক্যামেরার বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের কারণে এই যুগলের নাম সেকালে হয়েছিল 'কোডাক যুগল'।
ক্যামেরার পেছনে যারা
ইংরেজশাসিত ভারতে অন্তঃপুরের মহিলাদের ছবি তোলার জন্য গড়ে উঠেছিল বিশেষ সব ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠিত ইউরোপীয় মালিকানাধীন স্টুডিওগুলোতে নারীর প্রবেশের জন্য ছিল পৃথক দরজা। পালকিতে কিংবা পর্দায় ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে স্টুডিওতে পৌঁছানোর পর আগে থেকে প্রস্তুত ক্যামেরার সামনে নারীকে বসানো হতো। ফটোগ্রাফারের নির্দেশ মোতাবেক সঙ্গে আসা কিশোরী বা অন্য মহিলা ক্যামেরার লেন্স খুলে আবার বন্ধ করে দিত। আলোকচিত্রী প্লেট পাল্টে পরের ছবি তোলার প্রস্তুতি নিতেন। ১৮৯৪ সালে কলকাতার 'এফ ক্যাপ এন্ড কোম্পানি'র এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় স্টুডিওটিকে 'ঝঃঁফরড় ভড়ৎ তবহধহধ খধফরবং' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; কারণ, এতে মহিলাদের ছবি তোলার জন্য পৃথক প্রবেশপথের ব্যবস্থা ছিল। এ স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী ছিলেন ফ্রিৎজ ক্যাপ। ক্যাপ ছিলেন জার্মান নাগরিক। বিশ শতকের গোড়ায় নওয়াববাড়ির আমন্ত্রণে কলকাতার ব্যবসা ছেড়ে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তার তোলা ঢাকা নগরের নানা স্থাপনা এবং আহসান মঞ্জিলের আলোকচিত্র বিভিন্ন প্রকাশনায় বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। ঢাকায় তিনি একটি স্টুডিও চালু করেছিলেন এবং তা এক দশকের বেশি সময় চালু ছিল।
পুরুষের পাশাপাশি এ সময় শ্বেতাঙ্গ মহিলারা স্টুডিও ব্যবসায় এগিয়ে আসেন। প্রথম যে ইউরোপীয় পেশাদার মহিলা ফটোগ্রাফারের নাম জানা যায়, তিনি মিসেস ই মায়ার (ঊ. গধুবৎ)। কলকাতার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে ১৮৬৩ সালে তিনি একটি স্টুডিও খুলেছিলেন। এরপর যাদের বিষয়ে জানা যায়, তারা হলেন মিসেস ইম্প, মিসেস গ্যারিক, মিসেস উইন্স প্রমুখ। ভিনদেশি হলেও এদের অনেকে দেশি তরুণদের ছবি তোলার নিয়মকানুন শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মিসেস উইন্স প্রায় বছরখানেক ধরে রীতিমতন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে বাঙালি নারীদের ছবি তোলার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। বিশ শতকে পেশাদার মহিলা আলোকচিত্রীদের মাঝে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন এডনা লরেঞ্জ। ১৯১৩ সালে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে তিনি নিজস্ব স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেন। শিশুদের ছবি তোলায় তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এডনা লরেঞ্জের সান্নিধ্যে এসেছিলেন পথিকৃৎ আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডি। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, 'এডনা সেদিন আমাকে পোর্ট্রেটের সৌন্দর্যের কথা বলল। আমার আজ পর্যন্ত মনে আছে যে পোর্ট্রেট ন্যাচারাল হতে হবে। তুমি তোমার সাবজেক্ট নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না। যদ্দুর পারো যেন স্বাভাবিক রাখা যায়। ছবি শার্প হতে পারে কিন্তু মুড যদি ভালো না হয়, ন্যাচারাল ছবি তুমি পাবে না, এটা আজ পর্যন্ত আমি বজায় রেখেছি।'
দেশি নারীদের মাঝে প্রথম যে আলোকচিত্রীর নাম জানা যায়, তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যর স্ত্রী মনমোহিনী দেবী। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য প্রাথমিকভাবে তৈলচিত্র অঙ্কনের কাজে সুবিধা হবে ভেবে ফটোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হন। নিজে ইংরেজি ভালো জানতেন না। একান্ত সচিব তাকে বিদেশি ফটোগ্রাফির বই অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিতেন। বীরচন্দ্র ধীরে ধীরে প্রথমে দ্যাগারোটাইপ এবং পরে ক্যালোটাইপ ছবি তোলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। আশপাশের প্রকৃতি, আপনজন, সভাসদ, সবকিছুই ক্যামেরাবন্দী করতে চেয়েছেন তিনি। নিজ ক্যামেরায় তুলেছেন প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের ছবি। স্ত্রী মহারানি মনমোহিনী দেবীর ফটোগ্রাফিচর্চায় হাতে খড়ি তার হাতে। মহারাজার পাশাপাশি মনমোহিনী দেবীও আগরতলার প্রাসাদে নিয়মিত আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। তাদের তোলা ছবিগুলো 'জার্নাল অব ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া'তে 'দ্য ক্যামেরা ক্লাব অব দ্য পেলেস অব আগরতলা' নামে নথিভুক্ত আছে।
ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছবি তোলা শিখেছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ স্টুডিও 'বোর্ন এন্ড শেফার্ড'-এর কর্মীর কাছে। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরের বয়োজ্যেষ্ঠদের ছবি তুলবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কন্যা ইন্দিরা দেবীর মতে, তার মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এমন সব লোকের ছবি তুলেছিলেন, যাদের অন্য কোনো ছবি নেই বা হবারও সম্ভাবনা ছিল না।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে প্রথম যে বাঙালি মহিলা পেশাদার স্টুডিও ব্যবসায় নাম লেখেন, তিনি সরোজিনী ঘোষ। তার 'মহিলা আর্ট স্টুডিও'টি ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে। সরোজিনী ঘোষের প্রায় ২০ বছর পর এই পেশায় আসেন অন্নপূর্ণা দত্ত এবং দীর্ঘকাল স্টুডিও ব্যবসায় টিকে থাকেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালে। কোনো নামফলকধারী স্টুডিও তার ছিল না। নিজ বাড়িতেই ছবি তোলার কাজ করতেন। রক্ষণশীল ঘরে অনেক সময়ে নিজে গিয়ে ছবি তুলে আনতেন। বহু মুসলিম পরিবারে ছবি তোলার সূত্রে তার ছিল অবাধ যাতায়াত। হাসান সোহরাওয়ার্দী, কবি জসীমউদ্দীন, গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমেদের পরিবারের বহু ছবি তারই তোলা। এ সময়ে আরও যেসব মহিলা আলোকচিত্রীর নাম জানা যায়, তারা হলেন চঞ্চলাবালা দাসী, মীরা চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী, অন্নপূর্ণা গোস্বামী, দেবলীনা দেবী, মনোবীণা দেবী, ইলা মিত্র প্রমুখ।
এ দেশে মুসলিম মহিলাদের মাঝে ফটোগ্রাফির পথিকৃত হলেন সাইদা খানম। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৭ সালে পাবনায়। ছবি তোলার শুরুটা হয়েছিল মেজ বোনের উপহার দেওয়া রোলিকড ক্যামেরা দিয়ে। পাকিস্তান আমল তো বটেই, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন এ পেশায় তিনি ছিলেন একমাত্র নারী। ফটো সাংবাদিক হিসেবে 'বেগম' পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি ছবি তুলেছেন বিস্তর। তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছেন রানি এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, চাঁদে পদার্পণকারী নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন, মাইকেল কলিন্স প্রমুখ। তিনি সত্যজিৎ রায়ের উপর ডকুমেন্টেশন করেন। সাংবাদিক লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী সাইদা খানম সম্বন্ধে বলেন, 'ষাটের দশকে সাইদা খানমকে আমার মনে হতো সবচেয়ে আধুনিক। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে সারা শহর ঘুরে ছবি তুলত।' সাইদা লিখেছেন সেদিনগুলোর কথা, 'এই ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি যে ঢিল খাইনি, তা না। তবে সহযোগিতা পেয়েছি। ঢিল খাওয়ার কথাটা বাড়িতে বলতাম না, চেপে যেতাম।' মুসলিম নারী হিসেবে এই পেশায় তার সংগ্রাম অনুপ্রাণিত করে পরবর্তী প্রজন্মের অগণিত নারী আলোকচিত্রীকে।
তথ্যসূত্র:
১. ফটোগ্রাফী শিক্ষা, আদিশ্বর ঘটক, কলকাতা, ১৩০১ বঙ্গাব্দ
২. ছবি তোলা—বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চা, সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৯
৩. স্মৃতির পথ বেয়ে, সাইদা খানম, যুক্ত প্রকাশন, ২০১৩
৪. সেকালের ছবিওয়ালা, তারেক আজিজ। কবি প্রকাশনী, ২০২২