বাংলায় পর্তুগিজ জলদস্যুদের দিনগুলো...
১৭ শতকের গোড়ার দিকে মোগল শাসনের আওতায় ছিল বাংলা। সে সময় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার হাতে। তৎকালীন চট্টগ্রামে অনেক পর্তুগিজ বসবাস ছিল। গোয়াতে ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ। সেখান থেকে অবশ্য চট্টগ্রামের পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো না। বরং তারা চট্টগ্রামের বিকাশে সহায়তাই করত। এতে পর্তুগিজরা সহজেই আরাকান রাজার সন্তোষ অর্জন করতে সক্ষম হয়। পাইরার্ড ডি লাভাল ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম সফর করেন এবং এ বিষয়টি উল্লেখ করেন।
পাইরার্ডের লেখা থেকে জানতে পারি, বাংলার উপকূলের বন্দরটিতে বহু পর্তুগিজ স্বাধীনভাবেই বসবাস করত। কোনো নিয়মনীতি না মেনে বা সরকারি নিয়ন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই ব্যবসাপাতি চালাত তারা। অতীতে অপরাধ তৎপরতায় জড়িত থাকার দায়ে এসব পর্তুগিজের পক্ষে স্বদেশে ফিরে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। এরা কেউ খ্রিষ্টান পুরোহিত বা পাদ্রিও ছিল না।
১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আন্তোনিও ডি সুজা গোডিনহোকে গোয়া থেকে পর্তুগিজরা বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে আরাকানে পাঠায়। একটা নথিতে উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনটি জাহাজ নিয়ে তিনি পেগুতে যান। চট্টগ্রামের অদূরে দিয়াঙ্গায় তাকে একটা দুর্গ বানানোর অনুমতি দেন আরাকান রাজা। এ ছাড়া মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত সন্দ্বীপের নিয়ন্ত্রণও নেন তিনি। বাণিজ্যের জন্য এ দ্বীপের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রচুর কাঠ ছিল এখানে। নুনও উৎপাদন হতো এখানে। এই নুন গোটা বাংলায় সরবরাহ করা হতো। এসব কারণে অনেক পর্তুগিজ সন্দ্বীপে বসবাস করত। এতদসত্ত্বেও গোহিনহো দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি মনে করলেন, এ দ্বীপে একটি দুর্গ থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ দুর্গে সাগরপথে পৌঁছানো সহজ হবে না। (পর্তুগিজ) ইস্তাদো দা ইনজা বা ভারত সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে সেখানে সেনা পাঠানোও সহজ হবে না। তাই এদিকে পর্তুগিজদের সম্প্রসারণের কোনো মানে নেই বলে অন্য আরেক পর্তুগিজের লেখা চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়।
১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ ভাড়াটে নৌসেনারা সন্দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। দ্বীপ দখলের নেতৃত্ব দেন ডমিঙ্গোস কারভালহো এবং ম্যানুয়েল ম্যাটোস। বাংলায় ভাড়াটে নৌসেনা হওয়ার আগে কারভালহো ইস্তাদো দা ইনজার সৈনিক হিসেবে ভারতে আসেন। সন্দ্বীপ নিয়ন্ত্রণকারী সিরিপুরের রাজার অধীনে পর্তুগিজ ভাড়াটে নৌসেনাদলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিরিপুর যখন মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, সে সুযোগে কারভালহো এ দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করেন। দিয়াঙ্গার পর্তুগিজ অধিনায়ক ট্রিন্ডেড ম্যানুয়েল ডি ম্যাটোসের কাছে সাহায্য কামনা করেন। এ অ লের পর্তুগিজদের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। আরাকানের রাজা তাকে বাংলার গভর্নর হিসেবেও মেনে নেন। সাহায্য চাওয়ার জবাবে তিনি ৪০০ সেনা পাঠান। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে দিয়াঙ্গার পর্তুগিজদের ওপর হামলা করেন আরাকানের রাজ সেলিম শাহ। তখনো পর্তুগিজদের সেনা-সহায়তা দেওয়া হয় এখান থেকে। পর্তুগিজদের কাছে হেরে যায় আরাকানিরা। রাজা তাদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন। এ চুক্তিতে পর্তুগিজদের দিয়াঙ্গা এবং সন্দ্বীপে শাসন অব্যাহত রাখার অধিকার দেওয়া হয়। ম্যাটোস এবং কারভালহো তাদের মধ্যে সন্দ্বীপকে ভাগ করে নেন।
১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে কারভালহো এক পত্রে পর্তুগালের রাজাকে জাহাজ এবং কামান-গোলা পাঠিয়ে তাকে সহায়তা করার অনুরোধ জানান। চিঠিতে তিনি দাবি করেন, পর্তুগিজ রাজার নামে তিনি এ দ্বীপ জয় করেছেন। রাজা সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ম্যাটোস ও কারভালহোকে রাজ সম্মানে ভূষিত করেন। রাজ সম্মান গ্রহণের জন্য তাদের রাজ দরবারে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়। এই সম্মান গ্রহণ করার আগে কারভালহোকে স্থানীয় চন্দ্রিকানের রাজা নিজ দরবারে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। ফলে সন্দ্বীপটি কেবল ম্যাটোসের নিয়ন্ত্রণেই থেকে যায়। দৃঢ়চেতা আফগান মুসলমান ফুতেহ খানের সহায়তায় এই দুই এলাকাকে শাসন করেন ম্যাটোস।
১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানি বাহিনী দ্বীপটায় হামলা চালায়। তারা প্রায় ৬০০ পর্তুগিজকে হত্যা করে। আরাকানি হামলায় ম্যাটোস নিহত হয়। কিছুসংখ্যক পর্তুগিজ জঙ্গলে বা সাগরে পালিয়ে যেতে পারে। এদেরই একজন সেবাস্তিও গুদ আলভেস টিবাউ। পরে তিনি নিজেকে সন্দ্বীপ বদ্বীপ অঞ্চলের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬০৯ থেকে ১৬১৭ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা বজায় রাখেন।
সাদামাটা ঘরের সন্তান হওয়ায় ভারতে আসার আগে তার জীবন সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ১৬০৫-এ আত্মীয়স্বজনের সাথে ভারতে আসেন তিনি। অন্তত একজন জ্ঞাতিভাই তার সাথে ছিল। গোয়াতে কিছুদিন সেনার চাকরিও করেন। রাজ চাকরি ছেড়ে বাংলায় চলে আসেন। এরপর নুন ব্যবসায় লেগে যান। সে সময় নুন ব্যবসা হু হু করে বাড়ছিল। এ ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে ছোট জলযান কেনেন। এ জলযান দিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ব্যবসা করতেন। ১৬০৭-এ নুন নিয়ে দিয়াঙ্গোতে যান। আরাকান বাহিনী যখন হামলা চালায় তখন ৯-১০ জনকে নিয়ে এ জলযানে করে পালিয়ে যান। এভাবে পালিয়ে আসা অন্যদের নিয়ে টিবাউর জলদস্যু জীবনের অভিষেক হলো। প্রয়োজনের সময় ভেগে মেঘনার মোহনায় চলে যেতেন এবং সেখানে আশ্রয় নিতেন। বালকার রাজার সামান্য এলাকা ছিল ওখানে। তার সাথে পর্তুগিজ জলদস্যুদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।
ম্যাটোসের মৃত্যুর পর ফুতেহ খান স্থানীয় মুসলমানদের সহায়তায় নিজেকে স›দ্বীপের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬০৮-এ পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে নিজ অঞ্চলকে মুক্ত করার তৎপরতায় নামেন। কিন্তু তাদের সাথে নৌযুদ্ধে প্রাণ হারান। এ সময় বাংলা এবং আশেপাশের পর্তুগিজরা জলদস্যু চক্রের সাথে যোগ দেয়। তারা সম্মিলিতভাবে টিবাউকে তাদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে। ১৬০৯-এর মার্চে পর্তুগিজদের নেতা হলেন টিবাউ। বাকলার রাজার সহায়তায় টিবাউ সন্দ্বীপ হামলায় পর্তুগিজদের নেতৃত্ব দেন। ফুতেহ খানের এক ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন মুসলমানরা এ হামলা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে। পর্তুগিজরা দুই মাস সন্দ্বীপ দুর্গ অবরোধ করে রাখে। এ পর্বে পর্তুগিজরা খাদ্য ও গোলাবারুদের সংকটে পড়ে। এ সময় একটি স্পেনের জাহাজ ঘটনাক্রমে এসে হাজির হয়। পর্তুগিজদের এ জাহাজ সহায়তা জোগায়। এ কারণেই দ্বীপ দখল করতে তাদের আর তেমন বেগ পেতে হয়নি। টিবাউ দ্বীপটার নয় শাসক বনে যান। দ্বীপবাসী সব মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়।
টিবাউ সন্দ্বীপকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসন করতে থাকেন। তার তিন হাজার সেনার বাহিনীতে দুই হাজারই ছিল স্থানীয় লোকজন। এ ছাড়া ছিল ২০০ ঘোড়া এবং ৮০টা জলযান। শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে টিবাউ তার এককালের সুহৃদ বাকলার রাজাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। আশেপাশের কয়েকটা দ্বীপ দখল করে নেন। এ সময় বাংলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য পর্তুগিজ জলদস্যুদের একত্র করে নিজ বাহিনীতে নেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব টিবাউকে দেওয়া হয়। টিবাউ এবং চট্টগ্রামের পর্তুগিজ সম্প্রদায় প্রস্তাবদাতা পর্তুগিজ নাগরিককের কেউ সমর্থন করেনি।
একপর্যায়ে আরাকানের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন টিবাউ। শেষ পর্যন্ত টিবাউর সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন রাজা সেলিম শাহ। বাংলার মোগল সুবেহদার সন্দ্বীপসংলগ্ন দুটো এলাকা দখল করে নেন। বিপদের গন্ধ পেয়ে মোগলদের বিরোধিতা করবে বলে আরাকানের রাজার সাথে চুক্তি করে টিবাউ। চুক্তি মোতাবেক মোগলরা হামলা চালালে এগিয়ে গিয়ে হামলা করবেন টিবাউ। আরাকান রাজা না আসা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। চুক্তির সমর্থনে নিজ ভাতিজাকে আরাকান রাজার কাছে পণবন্দী হিসেবে পাঠিয়ে দেন টিবাউ। টিবাউ তার কথা রাখেননি।
১৬১১-এ মোগলদের সাথে আরাকানরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে টিবাউর টিকিও দেখা যায়নি। মোগলদের সাথে আরাকানিদের একাই যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে সেলিম শাহ হেরে চট্টগ্রামে চলে যান। টিবাউ তার বহরকে জড়ো করে আরাকানি সেনা কমান্ডারদের তার জাহাজে আসার আমন্ত্রণ জানান। তাদের সেখানে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তাদের জাহাজ দখল করে নেওয়া হয়। দখল করা জাহাজের নাবিকদের হয় দাস বানানো হয়; না হয় খুন করা হয়।
আরাকান উপকূলের গ্রামের পর গ্রাম লুটপাট করার জন্য কয়েকটি জাহাজ পাঠান টিবাউ। বদলা হিসেবে পণবন্দী হিসেবে পাঠানো টিবাউর ভাতিজাকে হত্যা করেন আরাকান রাজা। বিশ্বাসঘাতক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ টিবাউর কাছে এটি ছিল নিছক আটপৌরে ঘটনামাত্র। ভাতিজাকে হত্যা করায় তার দুঃখবোধ হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণই নেই।
১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ সেলিম শাহ মারা যান। তার ছেলে হুসাইন শাহ নাম ধারণ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের গভর্নর ছিলেন সেলিম শাহর এক ভাই রাজপুত্র আনাপেরুম। তিনি আরাকান সিংহাসনের এই উত্তরাধিকার মেনে নিতে পারেননি। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। হেরে সন্দ্বীপে ভেগে যান। সহায়তার জন্য টিবাউর দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। টিবাউ রাজপুত্রকে স্বাগত জানান। তার কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু অল্প দিন পরেই রাজপুত্র মারা যান। রাজপুত্রের সব সম্পদ টিবাউ কবজা করে নেন। সন্দেহ করা হয়, রাজপুত্রের মৃত্যুর পেছনে টিবাউর কারসাজি রয়েছে।
স্পেন এবং পর্তুগিজকে বাৎসরিক কর দিতে সম্মত আছে বলে গোয়ার ভাইসরয়কে জানায় জলদস্যুরাজ টিবাউ। একই সাথে আরাকানে হামলা চালালে সহজেই বিজয় অর্জন করা যাবে জানায়। আরাকান থেকে প্রচুর সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া যাবে বলেও লোভ দেখানো হয়।
কিন্তু ডাচদের সহায়তায় আরাকান রাজ পর্তুগিজ হামলা রুখে দিলেন। পর্তুগিজ বাহিনী পিছিয়ে সন্দ্বীপ চলে যেতে বাধ্য হলো। গোয়ায় ফিরে যেতে চাইল পর্তুগিজ সামরিক কমান্ডার। টিউবা অনুনয়-বিনয়কে গোনায় ধরল না গোয়া থেকে আসা কর্তাব্যক্তিরা। টিউবার দলের অনেকেই এই সুযোগের সদ্ব্যবহারে করে সন্দ্বীপ ছেড়ে ফিরল গোয়াতেই।
১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে ডাচের মদদপুষ্ট হয়ে সন্দ্বীপে পালটা আঘাত হানল আরাকান রাজ। এবারে আরাকান বাহিনী বিজয় অর্জন করল। দ্বীপের পর্তুগিজ শক্তি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হলো। টিবাউ ভেগে বাংলায় চলে গেলেন। জীবনের বাকি দিনগুলো বাংলা লেই কাটে তার। অবশ্য টিবাউকে সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন পর্তুগিজের রাজা। তাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয় গোয়ার ভাইসরয়কে। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে গেছে। এর এক বছর আগেই হুগলিতে মারা যান টিবাউ।
পর্তুগিজদের দস্যুতা তাতে থামল না, বঙ্গোপসাগরে আগের মতোই বহাল রইল। আরাকান রাজ কখনোই পুর্তগিজদের পুরোপুরি তাড়িয়ে দিতে বা ধ্বংস করতে চাননি। তার খায়েশ ছিল, পর্তুগিজদের তৎপরতা আরাকান রাজের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ১৬১৭-এর পর সন্দ্বীপের বাকি পর্তুগিজরা দিয়াঙ্গায় চলে যায়।
পর্তুগিজদের অস্ত্র-জ্ঞান খুবই ভালো ছিল। নাবিক হিসেবেও ছিল দক্ষ। ভালো যোদ্ধা হতে পারত তারা।
মোগলদের চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র এবং কামানবিদ্যায় পর্তুগিজরা সেরা ছিল। সব মিলিয়ে আরাকানের রাজ তাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য নিজ বাহিনীতে নিয়োগের খায়েশ করেন। এই সীমান্তেই মোগলদের সাথে আরাকান বাহিনীর লড়াই হতো। বাংলার পশ্চিমে পর্তুগিজদের ডাকাতি, জলদস্যুপনার প্রতি আরাকান সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখে। ফলে পর্তুগিজরা এ সুযোগে জলদস্যুবৃত্তিকেই মূল হিসেবে বেছে নেয়। স্থানীয় আরাকানিদের সাথে যোগসাজশ করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তাদের দস্যুতা চালিয়ে যেতে থাকে। জলদস্যুগিরির বিস্তৃতি দিয়াঙ্গা-চট্টগ্রাম থেকে আরাকান রাজ্য পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। দস্যুতায় অর্জিত মালামাল বা টাকাকড়ির আধাআধি বখরা যেত আরাকান রাজ দরবারেও। দাস হিসেবে আটক অসহায় আদম সন্তানদের আরাকানে বেচাকেনা করা যেত। আরাকানিরা তাদের কিনে নিয়ে চাষাবাদের কাজকর্মে লাগাতে পারত। আর না হয় পর্তুগিজরা তাদের নিয়ে অন্যান্য বন্দরে বিক্রি করতে পারত।
এমনকি ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাচরা বাটভিয়া থেকে মাঝে মাঝে চাল কেনার জন্য চট্টগ্রাম যেত। তারাও কখনো কখনো বাংলা থেকে দাস কিনে আনত। জলদস্যুদের অপতৎপরতা এতই ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে ঢাকার মোগল সুবেহদার নগরীর নদীর পাড় লোহার শিকল দিয়ে ঘিরে দেন।
মোগল ঐতিহাসিক শিহাব-উদ্দিন তালিশের রচনা থেকে জানা যায়, নদীপথে অবিরাম মগ, ফিরিঙ্গিসহ আরাকান জলদস্যুরা বাংলায় আক্রমণ চালাত। সুযোগমতো হিন্দু-মুসলমান সবাইকে ধরে নিয়ে যেত। বন্দীদের হাতের তালু ছিদ্র করে বেত ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তারপর তাদের ফেলে রাখা হতো জাহাজের তলের ডেকে। মুরগির পালকে আধার দেওয়ার মতো করেই প্রতিদিন সকালে চাল ছিটিয়ে দেওয়া হতো। উচ্চ বংশের অনেক মানুষ, অনেক ধর্মপ্রাণ বিশুদ্ধ নারী দাস জীবনের নিগ্রহ বা উপপত্নির দুর্ভোগে পড়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত নদীর দুই পাড়ের কোনো ঘরবাড়িই এই জলদস্যুদের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। বাকলা জেলা ঘন জনবসতিপূর্ণ ছিল। ব্যাপক পরিমাণে চাষের জমি ছিল। সুপারি বিক্রি করে ব্যাপক রাজস্ব আয় করত। জলদস্যুদের ধ্বংসলীলা এবং দাস হিসেবে মানুষজন ধরে নেওয়ার পর গোটা এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। ঘরে বাতি দেওয়ার মতোও কেউ ছিল না।
ফ্রিয়ার সেবাস্তিয়াও মানরিক বাংলায় আসেন ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে। সাগর দ্বীপ সফরে যান তিনি। এককালে সমৃদ্ধ এ দ্বীপ ঘন ঘন জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়েছে। দ্বীপবাসীরা অপহরণের মুখে পড়েছে বারবার। পরবর্তী সময়ে ক্রীতদাসের দুর্ভাগা জীবন তাদের ওপর নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে মানরিক দেখতে পান, এককালের সমৃদ্ধ দ্বীপটি জনশূন্য পোড়ো প্রান্তরের পরিণতিতে পড়েছে।
বছরে তিন থেকে চার দফা আক্রমণ করত জলদস্যুরা। তাদের মৌন সম্মতি দিয়েছিল গোয়ার পর্তুগিজ ইস্তাদো দা ইনজা বা ভারত সাম্রাজ্য। গোয়ার প্রাদেশিক পরিষদ মনে করত, জলদস্যুপনা কেবল ঠিকই নয়; বরং খ্রিষ্টানদের শত্রু মোগলদের বিরুদ্ধে এ তৎপরতা চলছে।
বাংলার সুবেদার চট্টগ্রামকে জলদস্যুমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্ত আদেশ আর দেওয়া হয়নি। এমন সিদ্ধান্ত ১৬৫৬ এবং ১৬৬৪-এ নেওয়া হয়েছি। ১৬৬৪-এ ৬০ থেকে ৭০টি জলদস্যুদের জাহাজ রাজবহরের ১৬০টি নৌকা ছিনিয়ে নেয়। একই বছরের শেষ দিকে জলদস্যুদের এক অভিযানে ভুসানা থেকে ২৭০০ থেকে ২৮০০ বাঙালিকে ক্রীতদাস হিসেবে আটক করা হয়। এবারে নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। বাংলার জাহাজ নির্মাণকারীদের যথাসাধ্য জাহাজ এবং নৌকা বানানোর নির্দেশ দেন সুবেদার শায়েস্তা খান। অভিযানে ডাচ এবং ইংরেজরাও তাদের বাহিনী পাঠায়। পর্তুগিজদের ক্ষমতা থেকে হঠানোর জন্য ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর মোগল অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য দুটো যুদ্ধজাহাজ পাঠান।
পুরো মাত্রায় প্রস্তুতি নিয়ে ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করেন শায়েস্তা খান। চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য দ্বীপের পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানো হয়।
এ লড়াইয়ে মোগলরা বিজয়ী হয়। মেঘনার মোহনায় সন্দ্বীপ থেকে পর্তুগিজ জলদস্যুদের নাম-নিশানা মুছে দেওয়া হয়। মোগলরা ১০২৬টি কামান, ১৩৫টি জাহাজ দখল করে। বহু আরাকানি সেনা নিহত হয়। হাজার হাজার সেনাকে আটক করা হয় এবং বিক্রি করা হয় দাস হিসেবে। চট্টগ্রামকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে এর নাম রাখা হয় ইসলামাবাদ।
মোগলরা নির্বিচারে পর্তুগিজদের ওপর হামলা করেনি। চট্টগ্রাম জয়ের আগে ঢাকার কাছাকাছি এলাকায় নুন ব্যবসায় জড়িত পর্তুগিজ বসতি স্থাপনকারীদের শরণাপন্ন হন শায়েস্তা খান। তাদের কাছে দূত পাঠান এবং চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানকার পর্তুগিজদের আরাকান পক্ষ ত্যাগ করে মোগলদের পক্ষে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে বলেন তার দূত। কিন্তু সত্যি কথাটি হলো, এতে কোনো ফয়দা হয়নি। ঢাকার পর্তুগিজরা চট্টগ্রামের পর্তুগিজদের মনোভাব পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হন।