কোনো দুঃখ নয়, লজ্জা নয়, এই দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদ মানেই পার্টি!
রাতের বেলা চাঁদের আলোর নিচে বসেছিল এই মেহেদি দেওয়ার আসর। গ্রাহকের হাতের উপর ঝুঁকে তার হাতে মেহেদির নকশা করে দিচ্ছিলেন হেনা আর্টিস্ট। মাঝেমাঝে নিজের পাশে রাখা স্মার্টফোনে দেখে নিচ্ছিলেন নকশা। আর যার হাতে মেহেদি পরানো হচ্ছিল- সেই ইজেলেখে জিলানি একটা মাদুরের উপর বসে ছিলেন এবং খুব সাবধানে লক্ষ্য রাখছিলেন যেন তার মেহেদি নষ্ট না হয়ে যায়; যেমনটা তিনি করেছিলেন নিজের বিয়ের দিন।
কিন্তু আজ তার বিয়ের দিন নয়। তাহলে এই তরুণীকে মেহেদি পরানোর উপলক্ষ্য কি? কারণ তার ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ হতে চলেছে! আর পরেরদিনই তার ডিভোর্স পার্টি!
এটুকু পড়েই অনেকে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুললেও, পশ্চিম আফ্রিকা দেশ মৌরিতানিয়ায় এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। আবার ফিরে যাওয়া যাক ইজেলেখে জিলানির মেহেদির আসরে।
জিলানির মা তারস্বরে তিনবার উলুধ্বনি দিয়ে এবং প্লাস্টিকের ট্রে পিটিয়ে আশেপাশের পাড়াপ্রতিবেশিদের ডেকে বলেন, "বিবাহিত নারীরা সবাই শুনুন, আমার মেয়ে ইজেলেখে জিলানি এখন একজন ডিভোর্সি নারী!" এরপর তিনি প্রথাগত রীতিতে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন যে তার মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদ অনেকটা দুই পক্ষের সম্মতিতেই হয়েছে। তিনি আরও বলতে থাকেন প্রতিবেশিদের উদ্দেশ্য করে- "আমার মেয়ে জীবিত আছে এবং তার প্রাক্তন স্বামীও জীবিত।"
এদিকে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা নেই জিলানির। সে হাসিমুখে নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত, স্ন্যাপচ্যাটে হাতের মেহেদির ছবি পোস্ট করছিল সে- আর এই পোস্টের মাধ্যমেই সে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে।
বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলেই ডিভোর্স মানে রীতিমতো বিভীষিকা হলেও মৌরিতানিয়ার পরিস্থিতি এমন নয়। এখানে কোনো নারীর ডিভোর্স হলে কান্নার রোল ওঠে না, তাকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয় না, পদে পদে অপমানিত হতে হয় না। বরং এখানে ডিভোর্সের পর চলে পার্টি।
মৌরিতানিয়ায় বিবাহবিচ্ছেদ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে এই বিষয়টিকে উদযাপন করা হয় এবং সবাইকে আরও জানিয়ে দেওয়া হয় যে এই নারী এখন মুক্ত এবং পুনরায় বিবাহ করতে পারেন। শতকের পর শতক ধরে দেশটিতে এমন রীতিই চলে এসেছে; ডিভোর্স পার্টিতে এসে নারীরা একসাথে বসে খাওয়াদাওয়া করেন, গান গান এবং নাচেন। তবে বর্তমানে সেলফি প্রজন্মের কাছে এই পার্টির ধরন কিছুটা বদলেছে। আজকাল তারা ডিভোর্স পার্টিতে কেক নিয়ে আসে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই উদযাপনের ছবি পোস্টও করে; সেইসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী খাবার ও সঙ্গীত তো আছেই।
প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশ মৌরিতানিয়ায় প্রায়ই ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে। এখানে একেকজন ব্যক্তি ৫ থেকে ১০টি বিয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান, এমনকি কেউ কেউ ২০বারও বিয়ে করেছেন বলে শোনা যায়।
দেশটির কোনো কোনো পণ্ডিতের ভাষ্যে, মৌরিতানিয়ায় ডিভোর্সের হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এ সম্পর্কে সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না মৌরিতানিয়ায়, কারণ বেশিরভাগ সময়ই মুখে মুখে এসব ডিভোর্স হয়ে থাকে, কোনো লিখিত দলিল পাওয়া যায় না।
মৌরিতানিয়ার সমাজে নারীদের নিয়ে গবেষণা করছেন সমাজবিজ্ঞানী নাজওয়া আল কাত্তাব। তার ভাষ্যে, মৌরিতানিয়ায় ডিভোর্স এতটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে ওঠার আংশিক কারণ হলো, মৌররা তাদের বার্বার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শক্তিশালী 'মাতৃতান্ত্রিক প্রবণতা' পেয়েছে। ডিভোর্স পার্টির মাধ্যমে যাযাবর সম্প্রদায় একজন নারীর বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে সবাইকে জানান দিত। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর তুলনায় মৌরিতানিয়ায় নারীদের স্বাধীনতা বেশিই বলা চলে। তারা আলাদা একটা ক্যারিয়ারও বেছে নিতে পারে, যেটাকে তিনি 'মাতৃতান্ত্রিক ক্যারিয়ার' বলে আখ্যা দেন।
আল কাত্তাব বলেন, "তরুণী, ডিভোর্সি নারী এখানে কোনো সমস্যার বিষয় না।" বরং এখানে ডিভোর্সি নারীদের আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হিসেবে দেখা হয় বলে তাদের চাহিদা আরও বেশি- "ডিভোর্স এখানে নারীর মূল্য বাড়াতে পারে", বলেন তিনি।
এদিকে জিলানি খুব সতর্কতার সাথে তার 'মেলাফা' ( চুল ও শরীরে পেঁচিয়ে ঢেকে রাখার লম্বা কাপড়; সাধারণত সাদা রঙ বেছে নেওয়া হয় যাতে সাদার মধ্যে মেহেদির গাঢ় রঙ ভালো ফুটে ওঠে) ঠিক করছিলেন। তার মা সালকা বিলাল বাড়ির আঙিনা দিয়ে লম্বা পদক্ষেপে হেঁটে গিয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিলেন। এই ছবিগুলো ক্যাম্পেইনের পোস্টারে ব্যবহৃত হবে।
বলে রাখা ভালো, সালকা বিলালেরও খুবই তরুণ বয়সে ডিভোর্স হয়েছিল। পরে তিনি একজন ফার্মাসিস্ট হন এবং পুনরায় আর বিয়ে করেননি। এখন তিনি তাদের ছোট্ট শহর ওয়াদানের জাতীয় আইনসভার প্রথম মহিলা সদস্য হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ওয়াদান শহরের জনসংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। ৯০০ বছরের পুরনো ধ্বংসপ্রাপ্ত এ শহরের বাসিন্দারা সাদামাটা পাথরের বাড়িতে বাস করেন।
সালকা বিলালের ডিভোর্স হওয়ার কারণেই তিনি পেশাগত জীবনে এতকিছু অর্জন করতে পেরেছেন। খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়, কিন্তু বিলালের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়া। আর যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তার স্বামী অন্য নারীদের প্রতি আসক্ত, তখন তিনি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন। তার প্রাক্তন স্বামী (যিনি এখন মৃত) তাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিলাল যাননি। ফলে ঐ ব্যক্তি তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা বন্ধ করে দেন এবং শেষ পর্যন্ত মাসে মাত্র ৩০ ডলার দিতেন তাদের পাঁচ সন্তানের ভরনপোষণের জন্য, বলেন বিলাল।
টাকার প্রয়োজনেই বিলাল প্রথমে একটি দোকান খোলেন এবং ধীরে ধীরে নিজের চেষ্টায় স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। গতবছর ওয়াদানে একটি নতুন হাসপাতাল চালু হয় এবং সেখানে চাকরি পান ষাটের কোঠায় থাকা সালকা বিলাল।
কিন্তু তার মেয়েদের গল্প আবার আলাদা। জিলানি বিয়ে করেছেন অনেক দেরিতে, ২৯ বছর বয়সে। আর ২৮ বছর বয়সী জায়দুবা সব বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বেশকিছু জায়গায় ইন্টার্নশিপ করেছেন।
মৌরিতানিয়ার অনেক নারীই মনে করেন, ডিভোর্সের ফলে তারা এক ধরনের স্বাধীনতা পান যা বিয়ের আগের বা বিয়ে করার পর পাননি, বিশেষ করে প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে। ডিভোর্সের নিয়ে মৌরিতানিয়ানদের এমন অকপটতা- যা বেশ আধুনিক চিন্তা বলেই মনে হয়- এর সাথে প্রথম বিয়ের প্রথাগত রীতিনীতি জড়িত। দেশটিতে মা-বাবারাই তাদের মেয়েদের জন্য পাত্র নির্বাচন করেন এবং খুব অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিতে চান। এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়, ফলে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো মতামত থাকে না।
ওয়াদানের আরেক বাসিন্দা লাকওয়াইলিয়া রেইজিল জানান, তার বিয়ে হয়েছিল কিশোরী বয়সে। তাকে না জানিয়েই তার বাবা বিয়ের আয়োজন করেছিলেন এবং পরে তাকে জানিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি তার স্বামীকে ডিভোর্স দেন। এরপর বিগত দুই দশকে তিনি একাধিকবার বিয়ে করেছেন।
রেইজিল জানান, তার ছয় স্বামীর কাউকেই তার নিজের পছন্দে নেওয়া হয়নি। "আমি তাদেরকে নিজের হৃদয়ের গভীরে স্থান দেই না। তারা আসে, যখন চলে যেতে মন চায় চলে যায়।"
কিন্তু বিয়েতে তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া না হলেও, ডিভোর্স তিনি নিজের ইচ্ছায়ই করতে পেরেছেন। মৌরিতানিয়ায় কিছু কিছু পরিস্থিতিতে আইনগতভাবে ডিভোর্স নেওয়া যায়। যদিও টেকনিক্যালি তা পুরুষকেই করতে হয় এবং প্রায়ই তা নারীদের চাপে পড়ে করেন তারা।
মৌরিতানিয়ায় ডিভোর্সের পর সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রেও নারীরাই প্রাধান্য পান। যদিও আইনত পুরুষেরা সন্তানের ভরনপোষণের খরচ দেওয়ার কথা, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই আইন মানা হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত নারীদের ওপরেই সেই আর্থিক চাপ এসে পড়ে।
কোনো নারী যদি কখনো ডিভোর্স নেওয়ার কথা চিন্তা নাও করেন এবং তারপরেও যদি এটা হয়ে যায়, তাহলেও সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয় মৌরিতানিয়ার নারীদের পক্ষে; অন্তত অন্যান্য দেশের তুলনায় তো সহজ বটেই। সমাজবিজ্ঞানী আল কাত্তাব বলেন, কারণ সমাজ এই নারীদেরকে নিন্দা করার বদলে বরং সহায়তা করে। "তারা বিষয়টাকে খুব সহজ করে তোলে, তাই অতীত ভুলে সহজেই সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়", বলেন তিনি।
আর ডিভোর্সি নারীকে সহমর্মিতা দেখানোরই একটা উপায় হলো ডিভোর্স পার্টি। জিলানি জানান, তিনি তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন কারণ তার স্বামী খুবই ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন, এমনকি মাঝেমধ্যে তাকে বাইরেও যেতে দিতেন না। ডিভোর্সের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তাকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি তিন মাস অপেক্ষা করেছেন এটা বুঝতে যে তিনি গর্ভবতী কিনা। যদি কোনো নারী গর্ভবতী হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
নিজের ডিভোর্স পার্টির দিনে জিলানি গালে ফাউন্ডেশন লাগিয়ে, আইব্রোটে সোনালি রঙ করে সেজেছিলেন। জানা যায়, এসব তিনি ইউটিউব দেখে শিখেছেন।
গাড় নীল রঙ এর মেলাফা গায়ে জড়িয়ে তিনি সামনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন পার্টিতে যোগ দিতে। তাদের পাথরে তৈরি বাড়ির লিভিং রুমে এই পার্টির আয়োজন করেছেন তার এক বন্ধুর মা।
পার্টিতে আসা নারীরা ক্যানড ক্রিমের মধ্যে খেজুর ভিজিয়ে রেখেছিলেন। এছাড়াও তারা রুটি দিয়ে উটের মাংস খাচ্ছিলেন। এর বাইরে ভাতের একটি আইটেমও ছিল।
আরও অনেক নারীরা এসে জড়ো হতেই তারা গান গাইতে শুরু করলেন। যাদের আগেপরে অনেকবার ডিভোর্স হয়েছে এবং এরকম অনেক পার্টিতেও গিয়েছেন, তারা প্রথমে ভালোবাসার গান গাইলেন এবং তারপরে নবীজীকে নিয়ে গান গাইলেন। আনন্দ, বিষাদ, দুঃখের গান- সব রকম গানই ছিল; সেই সঙ্গে ছিল ড্রাম ও হাততালির আওয়াজ।
যাযাবরদের ভূমি মৌরিতানিয়াকে কখনো কখনো লাখো কবির দেশ বলা হয়ে থাকে; এমনকি ডিভোর্সও এখানে কাব্যিক।
নোউকেচোট বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের অধ্যাপক আলহাজ উদ ব্রাহিম বলেন, "ডিভোর্সি নারীদের প্রলুব্ধ করা নিয়ে অনেক কবিতা আছে।" আর এটা যে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই রীতির ঠিক বিপরীত তাও জানালেন তিনি। তিনি বলেন, অনেক জায়গায়ই ডিভোর্সি নারীদের নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার এত বেশি যে ডিভোর্স মানেই মৃত্যুসম মনে করা হয়। আর মৌরিতানিয়ায় এখন আধুনিক উলুধ্বনি বা ডিভোর্সের কথা জানান দেওয়ার মাধ্যম হলো স্ন্যাপচ্যাট।
জিলানির ডিভোর্স পার্টিতে তার মা এসে বসলেন এবং অনেকটা সময় তিনি সবার সাথে সেলফি নিতে ও ফোনে ম্যাসেজিং এ-ই ব্যস্ত ছিলেন। সালকা বিলাল তার বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, "সে-ই শুধু বিয়ে আর পুরুষদের প্রতি আগ্রহী। তার মতো বয়সে আমি রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী ছিলাম।"
এরই মধ্যে উঠে গিয়ে বাইরে কিছু সম্ভাব্য ভোটারের সাথেও কথা বলে এলেন বিলাল। তিনি বলেন, "আমি তরুণদের কাছে গিয়ে গিয়ে ভোট চাইছি।"