ডিভোর্সের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর দিক কি জানেন?
ডিভোর্সের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো এর মানসিক, আর্থিক এবং সামাজিক প্রভাব। বিশেষ করে, যখন পরিবারে সন্তান থাকে, তখন ডিভোর্সের পরিণতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আমরা যদি বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, ডিভোর্সের হার কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা শহরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৪০ মিনিটে একটি করে ডিভোর্স কেইস ফাইল হচ্ছে এবং ২০২২ সালে ১৫ হাজারেরও বেশি ডিভোর্স কেইস ফাইল হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ ডিভোর্স কেইস দায়ের করেছেন নারীর— যা সমাজে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করেছে; যেখানে সম্পর্কের মূল্যায়ন এবং দায়বদ্ধতা অনেক কমে যাচ্ছে।
ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো সন্তান। যখন বাবা-মার মধ্যে ডিভোর্স হয়, তখন সন্তানরা মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন বাচ্চার জন্য মা এবং বাবা– উভয়েরই উপস্থিতি প্রয়োজন। তবে ডিভোর্সের পর সন্তানরা হয় মাকে মিস করে, নয়তো বাবাকে। বিশেষ করে, যখন মা বা বাবা নতুন করে বিয়ে করেন, অন্যকোনো সংসারে চলে যান— তখন সন্তানদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে আরও বড় সমস্যা দেখা দেয়।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব বাচ্চার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা এবং পড়াশোনায় আগ্রহ হারানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তারা অনেক সময় স্কুলে বা খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে বাধ্য হয়— যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। (তথ্যসূত্র: এপিএ, সেপ্টেম্বর ২০১৯)
সন্তানদের জন্য মায়ের ভালোবাসা এবং বাবার স্নেহ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ডিভোর্সের পর সন্তান যখন কাউকে মিস করে, তখন তার জীবন মানসিকভাবে আরও জটিল হয়ে ওঠে। বাবা-মার অনুপস্থিতি সন্তানের সামাজিক ও মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।
ডিভোর্সের আরেকটি বড় প্রভাব হলো এর আর্থিক ক্ষতি। পুরুষ এবং নারী উভয়েই ডিভোর্সের পর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিশেষ করে, নারীদের জন্য নতুন করে জীবন শুরু করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিভোর্সের পর নারীরা তাদের আর্থিক স্বাবলম্বন হারায় এবং প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে নতুনভাবে জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন না। (তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, এপ্রিল ২০২১)
পুরুষদের ক্ষেত্রেও আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ক্ষতি বড় একটি ব্যাপার। ডিভোর্সের পর অনেক পুরুষই সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েন। তাদের নতুন সঙ্গী খুঁজে পাওয়া বা সামাজিক মানসিকতার সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। একইভাবে, নারীদেরও সামাজিক এবং পারিবারিক চাপের মুখে পড়তে হয়; বিশেষ করে, সন্তানসহ নতুন জীবন শুরু করতে গেলে।
ডিভোর্সের সংখ্যা কমানোর জন্য সামাজিক সচেতনতা এবং কাউন্সেলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে কাউন্সেলর এবং পারিবারিক বিশেষজ্ঞ-এর সংখ্যা কম; যার ফলে দম্পতিদের মধ্যকার সম্পর্কের সমস্যাগুলো সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, যেসব দেশে পারিবারিক কাউন্সেলিং সহজলভ্য, সেসব দেশে ডিভোর্সের হার অনেক কম।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক পরামর্শদাতা– যারা বিবাহিত দম্পতিদের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেন– তাদের সাহায্যে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডিভোর্স এড়ানো সম্ভব হয়। (তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, মার্চ ২০২০)
সুতরাং, পারিবারিক সম্পর্ককে সুরক্ষিত রাখতে এবং সন্তানের মানসিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য ডিভোর্সের আগে একটি সম্পর্ককে আরও ভালভাবে বোঝা এবং প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং করানো অত্যন্ত জরুরি।
ডিভোর্সের প্রভাব শুধু দুজন মানুষের সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতায় সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি সন্তানদের জীবন, আর্থিক অবস্থান এবং সামাজিক কাঠামোকেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই, ডিভোর্সের আগে উভয় পক্ষের দায়িত্ব হলো সমস্যাগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা এবং কোনো সম্ভাব্য সমাধান আছে কিনা তা যাচাই করা। সন্তানের মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে, ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ভাবা উচিত, যাতে পরিবারের স্থায়িত্ব এবং সম্পর্কের মূল্যবোধ রক্ষা করা যায়।
- লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।)