জিগাতলা থেকে সাতমসজিদ সড়ক: রাজধানীর রেস্তোরাঁবহুল এলাকা কতটা নিরাপদ
গাউছিয়া টুইন পিক নামের ১৪ তলা ভবনটি রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে অবস্থিত। এই ভবনে রয়েছে ছোট-বড় অন্তত ২০টি রেস্তোরাঁ। ভবনের স্থপতি (আর্কিটেক্ট) মোস্তফা খালিদ পলাশ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, নির্মাণের সময় অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে ভবনের মালিকেরা মুনাফা করাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। ভবনটির নকশা ও ব্যবহারে নিরাপত্তা বিধির ব্যতয় হওয়ায় তাদের 'অর্থলিপ্সু' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে সবাইকে এই ভবনটি ব্যবহার না করার অনুরোধ জানান তিনি। বরং এর পরিবর্তে রাস্তার খাবারের দোকানে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
আশেপাশের এলাকার মধ্যে এই ভবনটিই একমাত্র নয়। জিগাতলা থেকে সাতমসজিদ রোড পর্যন্ত রয়েছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি রেস্তোরাঁ। এই সংখ্যা প্রায় একশ হবে। কিছু কিছু বহুতল ভবনের প্রতিটিতে অন্তত ডজনখানেক রেস্তোরাঁ রয়েছে। ফলে অপরিসর সিঁড়ি ও লিফটে চলাচলে গ্রাহকদের ভিড় লেগেই থাকছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের মারাত্মক অগ্নিদুর্ঘটনা কবলিত ভবনের কথাই মনে করিয়ে দেয়– এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা।
এই এলাকায় বহু সংখ্যক বাণিজ্যিক ভবন থাকায় সেখানে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা মূল সমস্যা নয়। তবে সেজন্য ভবনের কিছু নিরাপত্তা বিধিমালা ও মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। ভবনে থাকা বিভিন্ন প্রকার ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই যা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
যেমন কোনো ভবনে রেস্তোরাঁ থাকলে সেখানে অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা, জরুরী নির্গমণ পথ, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকা দরকার। কোনো দুর্ঘটনার সময়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও গ্রাহকদের সতর্ক করতে বিভিন্ন রকমের নিরাপত্তা সাইন বা নির্দেশক থাকতে হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির তথ্যমতে, শুধু ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকাতেই রয়েছে প্রায় ৩০০ রেস্তোরাঁ।
এজন্যই রেস্তোরাঁ থাকা ভবনগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কি না সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। বিশেষত বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় অনেক সচেতন নাগরিকই এই প্রশ্ন তুলেছেন। ওই ভবনে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দোকানপাটও ছিল।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মতে, একটি রেস্তোরাঁ শুরু করতে তাদের ১২ রকমের সনদ নিতে হয়। তবে কতগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে এসব সার্টিফিকেট নিয়েছে বা যথাযথ মানদণ্ড মেনে পরিচালিত হচ্ছে– তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
সংগঠনটির যুগ্ন-সচিব সৈয়দ মোহাম্মদ আন্দালিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শুধু রেস্তোরাঁ না, অগ্নি-দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।"
রমজানের আগে সব রেস্তোরাঁ মালিকদের চিঠি দিয়ে, চেকলিস্ট তৈরি করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বলা হবে বলেও জানান তিনি।
ভবনের ক্যাটাগরি মেনে না চলা
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, সাতমসজিদ সড়কের বেশিরভাগ ভবনই প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য, রাজউক যেগুলো এফ-১ ক্যাটাগরি-ভুক্ত করেছে। এগুলোতে শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপনের অনুমতি রয়েছে।
কিন্তু, অফিস স্পেসের চাহিদা তেমন না থাকায় এবং সে তুলনায় রেস্তোরাঁ ব্যবসার উচ্চ মুনাফার কারণে– ভবন মালিকরা এসব নিয়ম ভঙ্গ করতে শুরু করেন।
রাজউকের একজন পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, ''সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি নিয়ে ভবনের ক্যাটাগরি পরিবর্তন না করা হলে– বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ভবনে রেস্তোরাঁ করা যাবে না।''
সাতমসজিদ রোডের অন্যতম পুরনো রেস্তোরাঁ স্টার কাবাব প্রতিষ্ঠা করা হয় নব্বইয়ের দশকে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মির আক্তার উদ্দিন দুলাল বলেন, "১৯৯৬ সালে জায়গা ভাড়া নিয়ে আমরা এই রেস্তোরাঁ চালু করি। সাড় পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় আমাদের রেস্তোরাঁ, ফলে অনেকটাই খোলামেলা এবং ফায়ার এক্সিটের জন্য অনেক জায়গা আছে।"
এই সড়কে কেন এত রেস্তোরাঁ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "বাড়িওয়ালারা রেস্টুরেন্ট ভাড়া দিলে প্রফিট কিছুটা বেশি পান। ধরেন অফিস ভাড়া দিলে যেখানে ১০০ টাকা পাবে, রেস্টুরেন্ট দিলে সেটা ১২০-১৩০ টাকা পেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "সাতমসজিদ রোডে অন্তত ৫০টা বহুতল ভবন আছে। কিন্তু, অফিসের জায়গার জন্য চাহিদা তেমন নেই। তাই বাড়িওয়ালারা লাভের আশায় রেস্টুরেন্ট ভাড়া দিচ্ছেন।"
দীর্ঘদিন যাবৎ সাতমসজিদ এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে যাতায়াত আছে এমন একজন গ্রাহক টিবিএসকে জানান, ছুটির দিনে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় যান, তখন খদ্দেরদের ভিড়ে জমজমাট থাকে।
"কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা হলে– অপ্রশস্ত ফায়ার এক্সিট দিয়ে নামা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। হয়ত আমি পারব, কিন্তু আমার বাচ্চার কী হবে? প্রতিটি ভবনে সাধারণত দুটি থেকে চারটি করে লিফট, সিঁড়িগুলোও সরু বা অপ্রশস্ত"- বলেন তিনি।
সাতমসজিদ রোডের রেস্তোরাঁগুলোর আরেক নিয়মিত খদ্দের আরিফুজ্জামান ফেসবুকে লিখেছেন, "ভবনগুলো বানানোর সময় নিশ্চিত করে বলা যায়– রেস্টুরেন্টের জন্য বানানো হয়নি।"
জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের ট্রাম্প টাওয়ারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "এটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরও– ভবনটিতে কোনো ভাড়াটিয়া ওঠেনি। এরপর আস্তে আস্তে একদিন দেখলাম গোটা ভবনে রেস্টুরেন্ট।"
রেস্তোরাঁয় আগুনের ঝুঁকি বেশি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ভবনে রেস্তোরাঁ বেশি, সেখানে আগুনের ঝুঁকিও উচ্চ। এজন্য বিল্ডিং কোড ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে রাজউকের মতো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্থপতি মোস্তফা খালিদ পলাশ বলেন, "একটি ভবন যত ভালোভাবেই বানানো হোক না কেন, সেটা যদি সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট ভবনে রূপান্তরিত হয়, তাহলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। সমস্যা হলো আইনের মধ্যে ফাঁক আছে।" অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ডেভেলপার কোম্পানি ও ভবন মালিকদের উদাসীনতা নিয়েও আক্ষেপ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বাণিজ্যিক ভবনকে রেস্তোরাঁ ভবনে রুপান্তরিত করাটা অবৈধ এবং এটা হতে দেওয়াই উচিত নয়।
"বিধিমালা অনুযায়ী অনেক ভবনের দুটি করে সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু, অনেক ভবনেই ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি মালামাল রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা"- তিনি বলছিলেন।
আদিল মোহাম্মদ আরও বলেন, "অনেকেই ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন করে অ-আবাসিক ক্যাটাগরিতে ফেলে। এই "অ-আবাসিক" নামের ব্যবহার করে আবাসিক ভবন ভিন্ন উদ্দেশে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দীন বলেন, ''উচ্চ ঝুঁকি থাকায় রেস্তোরাঁগুলোয় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হবে।'' তবে সাতমসজিদ সড়কের রেস্তোরাঁগুলোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ''ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকার অনেক মার্কেট, দোকান, রেস্তোরাঁয় স্টোভ চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে।''
ভবন মালিকদের শর্তসাপেক্ষ লাইসেন্স দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি নিরাপত্তা মানদণ্ডগুলো মেনে চলা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
সাম্প্রতিক এক জরিপে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, আবাসিক ও বাণিজ্যিকসহ রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।
বারবার সতর্ক করার পরও অনেক ভবনের মালিক তা গ্রাহ্য করছেন না। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ ভবনকে অতি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, অগ্নিনিরাপত্তা ও অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় নিয়মিত জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস এক হাজার ১৬২টি সরকারি, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ১৩৬টি ভবনকে অতি-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর ৪৯৯টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দীন বলেন, ''পরিদর্শনের পর চিঠির দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিকদের সতর্ক করা হয়। তারপরেও বেশিরভাগ মালিক সতর্কতা উপেক্ষা করে নিরাপত্তা গাইডলাইন মেনে চলেন না।''
২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাকার ৫৮টি মার্কেট পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ৯টি মার্কেট অতি-ঝুঁকিপূর্ণ, এবং ১৪টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।