মেয়র ছাড়া কীভাবে চলছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম?
দেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে মেয়র ও কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের দুদিন আগেই, গত ৩ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। আর ৫ আগস্ট থেকেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ পালাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন, আর বাকিরা আছেন আত্মগোপনে।
এছাড়া দুই সিটির প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাই এখন অফিস করছেন না।
ফলে দুই সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক কর্মকাণ্ড, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অধিকাংশ কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে অল্প কিছু কর্মচারী নিয়ে কোনোমতে চলছে শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধন কার্যক্রম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলর অফিসগুলোর কার্যক্রম চালু না থাকায় আর্থিক কার্যক্রম ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সেবা বন্ধ আছে। 'নতুন সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেভাবে কাজ করব।'
দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অফিস করলেও এতদিন বঞ্চিত থাকার দাবি করে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদেরকে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করেছেন ও হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে তুমুল কথাকাটাকাটির ঘটনাও ঘটেছে।
সিইও ও জোনাল অফিসের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরুর আহ্বান নগর বিশেষজ্ঞদের
এদিকে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের সেবা কোনোভাবেই বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জোনাল অফিসের মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে বলে মত দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানার্স-এর সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, 'যেহেতু সরকার গঠন হয়েছে, সেহেতু খুব দ্রুতই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা দরকার।
'সিটি কর্পোরেশনের মেয়র না থাকলেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জোনাল অফিসারদের মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে।'
আতঙ্কে কর্মকর্তা ও কাউন্সিলররা
টিবিএসের এই প্রতিবেদক দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রভাবশালী অন্তত ৩০ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাদের বেসিরভাগের ফোন নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকজন কল রিসিভ করেননি।
যারা ফোন রিসিভ করেছেন, তাদের একজন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তফাজ্জল হোসেন টেনু। তিনি টিবিএসকে বলেন, রাজধানীর চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে তিনি অফিসে বসতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ফোনে ফোনে কর্মচারীদের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা উত্তরের ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুজিব সরওয়ার মাসুম বলেন, 'এখন দেশে যেহেতু কোনো আইনশৃঙ্খলা নেই, সেহেতু কোনো কাজে বের হতে পারছি না। স্বাভাবিক কাজ একপ্রকার বন্ধই আছে। শুধু মশক কর্মীরা ওষুধ দিচ্ছেন এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা পরিষ্কার করছেন।'
ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস টিবিএসকে বলেন, 'কাজ করারা সুযোগ কোথায়? জীবন বাঁচানোই দায়।'
চিত্তরঞ্জন বলেন, বর্তমানে তিনি একপ্রকার আত্মগোপনেই আছেন। ফোন দিয়ে বর্জ্য ও মশক নিধন কার্যক্রম কিছুটা চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'বর্তমান সরকার যদি সবকিছু স্থিতিশীল করে, তাহলে আমরা কাজে নামতে পারব।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, তারা মাঠে যেতে না পারলেও যেসব কর্মচারী মাঠে কর্মরত আছেন, তাদের মাধ্যমে অনলাইনে তথ্য আদানপ্রদান কছেনছি।
তিনি বলেন, 'কিছু কিছু জায়গায় কর্মকর্তারা হুমকিতে থাকায় ওই সব এলাকায় পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকবল দিয়ে কাজ পরিচালনা হচ্ছে।'
তাপসের পালিয়ে যাওয়াকে 'প্রতারণা' মনে করছেন কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীরা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তার কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের না জানিয়েই ৩ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ায় অধিকাংশই তার ওপর ক্ষুব্ধ।
একজন কাউন্সিলর টিবিএসকে বলেন, 'আমাদেরকে গভীর সমূদ্রে ফেলে রেখে তিনি (মেয়র তাপস) পালিয়ে গেলেন। আমরা জানতামও না যে তিনি দেশে নেই। আমরা মাঠে ছিলাম, যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।
'কিন্তু এখন আমরা আমাদের কার্যালয়, বসতবাড়ি হারিয়েছি; সাথে সাথে জনগণের কাছে সম্মানও হারিয়েছি। মেয়র তাপস আমাদের সাথে প্রতারণা করেছেন।'
দক্ষিণ সিটির ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, 'আমার জানতামই না যে মেয়র তাপস দেশে নেই। ৫ তারিখের পরে গণমাধ্যমে ছবি দেখে জানতে পেরেছি যে তিনি পালিয়েছেন। কী বলব, বলার কিছু নেই।'
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে আজ
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপেদেষ্টা পরিষদ আজ রোববার (১১ আগস্ট) একটি সভা করবে।
ওই সভায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ এর পরে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।