ত্রিদিব দস্তিদার: বুকে তার কান্নার গভীর সমুদ্র
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করার সুবাদে আমি জীবনে যেসব কবি-সাহিত্যিকদের সহচর্য পেয়েছি তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি ত্রিদিব দস্তিদার। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতেই ত্রিদিব একদিন এসেছিল আমাদের অফিসে। উনিই আমার সঙ্গে ত্রিদিবের পরিচয় করিয়ে দেন। ত্রিদিব আর আমি ছিলাম সমবয়সী। দুজনেরই ৫২ সালে জন্ম। সেভাবেই আস্তে আস্তে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে জন্মে ত্রিদিব। সেখানেই লেখাপড়া করেছে। ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে ১৯৭৬ সাল থেকে।
ত্রিদিবের জীবনটা ছিল নিষ্প্রাণ বিপর্যস্ত এক জীবন
ত্রিদিব কবিতা লিখতো। চেহারাতেও সেরকম এক কবি কবি ভাব ছিল। বড় দাঁড়ি, বড় চুল। কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তবে, কাপড়-চোপড়ের বেলায় সে ছিলো খুব সচেতন। সবসময় ভালো পোশাক পরতো। আমার মনে আছে, শুধু একটি ভালো জিন্সের প্যান্ট কেনার জন্য ত্রিদিব সারাটাদিন মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়িয়েছে।
ত্রিদিব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতো। কিন্তু টাকার অভাবে মেসে থাকায় সেটাও সম্ভব হতো না সবসময়। একবার বিছানায় অন্যরা কাপড় রেখেছিল বলে বাকবিতণ্ডা হতে হতে মারামারি পর্যন্ত সে করেছে। তার মানে কতটা সচেতন ছিল সে এসব বিষয়ে!
অথচ ত্রিদিবের জীবনটা ছিল নিষ্প্রাণ বিপর্যস্ত এক জীবন। ছোটোবেলায় তার মা মারা যায়। এরপর বাবাও গৃহত্যাগ করে সন্নাসী জীবন শুরু করে। ত্রিদিবের পরিবার বলতে ছিল শুধু তার দুজন বোন। ত্রিদিবের কথাতেও বারবার সেই দুই বোনের কথাই উঠে এসেছে।
কিন্তু এই পরিবারটি ছিল খুব অভিজাত এবং সংস্কৃতমনা। রাজনীতির মাঠেও ছিল সরব। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক আন্দোলনের মতো প্রতিটি জায়গায় ছিল ত্রিদিবের পরিবারের অংশগ্রহণ।
ত্রিদিব অভিজাত মানুষ হলেও তার জীবন ছিল উলটো। অভিজাত মানুষদের খুব পছন্দ করতো সে। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে যে দুজন নিরেট মানুষের সহচর্যে আমি এসেছিলাম, তারা হলেন, হাসান হাফিজুর রহমান ও ত্রিদিব দস্তিদার।
ত্রিদিব সবার সঙ্গে মিশতে পারতো না তেমন
ত্রিদিবের অসহায় জীবনের জন্য হয়তো মানুষও তাকে কিছুটা ছোটো চোখে দেখতো। জীবনে বোধহয় কোনোদিন সুখ পায়নি সে। কেউ যদি তার জীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি গল্প জানে, তবে বুঝবে কতটা দুর্দশাগ্রস্ত এক জীবন সে কাটিয়েছে পৃথিবীতে।
অনেকেই হয়তো জানেনা যে তার বিয়ে হয়েছিল। জীবনে তার যতগুলো করুণ গল্প ছিল, এটি ছিল অন্যতম। ১৯৭১ সালে ত্রিদিব এক পর্তুগীজ নারীকে বিয়ে করে। মেয়েটির নাম ছিল মারিয়া। কিন্তু মেয়ের পরিবার এই বিয়ে মেনে না নেওয়ায় মারিয়াকে তারা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এরপর মারিয়াও আর ফেরত আসেনি। ত্রিদিবও একপর্যায় গিয়ে আর খোঁজ রাখেনি। কিন্তু কেন রাখেনি? উত্তরে বলেছিল, 'আমার যে জীবন, একদিন না একদিন হয়তো চলেই যেত আমাকে ছেড়ে।'
কতটা দুঃখ পেলে মানুষ এরকম কথা বলতে পারে!
অনেক বড় মনের মানুষ
ত্রিদিব ছিল মনের দিক থেকে অসম্ভব বড় মনের মানুষ। একবার খুব আফসোস করে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনা আমাকে বলেছিল। পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে একটি মেয়ে খড়ের ভিতর লুকিয়েছিল। কিন্তু পুরো শরীর লুকালেও, পা দুটো দেখা যাচ্ছিল। পাক বাহিনী ঐ পা দেখেই মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যায়। খুব আফসোসের সঙ্গে সেই মেয়েটির গল্প বলতো। বলতো, 'শুধু পাটুকুর জন্য পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল মেয়েটার'।
একবার বোনদের বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে বলে ছুটি চেয়েছিল। কিন্তু সরকারি অফিস বলে যখন তখন ছুটি নেওয়াও যেতো না। তাই ছুটি মঞ্জুর করিনি। খুব রাগারাগি করে বের হয়ে গিয়েছিল সেবার ত্রিদিব। সাতদিন পর দেখি অফিসে এসে বসে আছে, কাজ করছে।
ত্রিদিবকে বুঝতে হলে আসলে তার জীবনটাকে জানতে হবে
অফিসের অনেকেই তাকে পছন্দ করতো না তার এরকম বাউণ্ডুলে জীবনের জন্য। কিন্তু ত্রিদিবকে বুঝতে হলে আসলে তার জীবনটাকে জানতে হবে। আমি জানতাম বলেই হয়তো তার প্রতি আমার এত মমতা ছিল।
আমাকে ডেকে ত্রিদিব কবিতা পড়ে শোনাতো মাঝে মাঝে। তার 'চোখ' কবিতাটা, আর 'তোমাদের এই দেখা বড় দেরি হয়ে গেল' এই দুটো আমার খুব ভালো লাগতো। তার লেখাগুলো মূলত এরকমই ছিল- যেন এক আফসোস চারপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে। হয়তো কেউ তাকে বুঝতে পারতো না বলেই। আসলে ত্রিদিবের জন্য বেঁচে থাকাটাই ছিল অনেক বড় একটি বিষয়।
তবে তার কবিতার ভক্ত ছিল অনেক। হাসান ভাইও তাকে স্নেহ করতো। হাসান ভাই ত্রিদিবের কবিতার ব্যাপারে একটি কথা বলতেন- 'ওর কবিতায় একটা জীবনীশক্তি ছিল। যেটা অনেক কবিদেরই নেই।'
মানুষের ঘুমকে ত্রিদিব সম্বোধন করতো, 'স্বাস্থ্যবান টিম্বার পোকা' নামে। ত্রিদিবের দেখার চোখই ছিল আসলে তেমন।
১৯৮৪ সালে প্রকল্পের কাজ ছেড়ে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে দেখা হতো ত্রিদিবের সঙ্গে। কিছুদিন মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতেও কাজ করেছে সে। বেলাল ভাইও সাহায্য করেছেন অনেক।
একজন একাকী ত্রিদিব
ত্রিদিবের কোনো ঘর ছিল না, হোটেলে থাকতো। একবার ডায়রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাকে দেখারও কেউ ছিল না। ডায়রিয়া থেকে পানিশূন্যতায় তার মৃত্যু ঘটে শেষ পর্যন্ত।
একা মানুষ হওয়ার কারণেই হয়তো ত্রিদিবের মনটা ছিল নিরেট। শিশুর মতো কবিতা অনুভব করতো, লিখতে পারতো। আমাদের ভদ্রলোক কবিগোষ্ঠী ত্রিদিবের মতো মানুষকে সবসময় ছোটো চোখেই দেখেছে। কখনো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়নি।
ত্রিদিবের কবিতা নিয়ে তরুণদের মাঝে অনেক উত্তেজনা আবেগ দেখি আমি। কিন্তু তারা কি জানে, ত্রিদিবের জীবনটা আসলে কতটা কষ্টের ছিল? হয়তো তাদের জন্যই আমার ত্রিদিবকে নিয়ে এই ছোট্ট স্মৃতিচারণ।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক