শান্ত-সাকিবের ব্যাটে অবশেষে জয়ের আঙিনায় বাংলাদেশ
প্রত্যাশিত জয়ে শুরু বিশ্বকাপ অভিযান। পরের ম্যাচ থেকে লক্ষ্য শুধু এগিয়ে যাওয়া, সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়া। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে যে হতাশার গল্প লেখা শুরু করে বাংলাদেশ, তা চলতেই থাকে। সাকিব আল হাসানের দলের জন্য হার হয়ে ওঠে অমোঘ নিয়তি। টানা ছয় ম্যাচ হেরে ছিটকে যেতে হয় সেমির দৌড় থেকে। পরের লক্ষ্য দাঁড়ায় পয়েন্ট টেবিলে সেরা আটে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি তাই ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ, আর এই ম্যাচে এসে জয়ের দেখা মিললো। অবশেষে একটি ম্যাচ জিতলেন সাকিব-মুশফিকরা।
সোমবার দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে আট ম্যাচে এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়। টানা ছয় ম্যাচ হারের পর জয়ের স্বাদ পেল ব্যর্থতার বৃত্তে আটকে যাওয়া দলটি। এই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার সাত নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ, বেঁচে থাকলো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা করে নেওয়ার আশা। আট ম্যাচে দুই জয়ে সমান ৪ পয়েন্ট নিয়ে আট নম্বরে নেমে গেছে শ্রীলঙ্কা। নেদারল্যান্ডস ৯ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড আছে ১০ নম্বরে।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করা শ্রীলঙ্কা চারিথ আসালাঙ্কার সেঞ্চুরি এবং পাথুম নিসাঙ্কা, সামারাবিক্রমা ও ধনঞ্জয়া ডি সিলভার ছোট কিন্তু কার্যকরী ইনিংসে ৪৯.৩ ওভারে সব ক'টি উইকেটে ২৭৯ রান তোলে। জবাবে নাজমুল হোসেন শান্ত ও ম্যাচসেরা সাকিবের রেকর্ড জুটির পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তাওহিদ হৃদয়রা দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। ৪১.১ ওভারেই জয় নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
লক্ষ্য তাড়ায় তেড়েফুঁড়ে শুরু করার চেষ্টা করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম ও লিটন কুমার দাস। ভালোই ব্যাটে-বলে হচ্ছিল তাদের। এরপরও অবশ্য উদ্বোধনী জুটিটা বড় হয়নি বাংলাদেশের। দলীয় ১৭ রানেই ক্যাচ তুলে বিদায় নেন তানজিদ হাসান। ৫ বলে ২ চারে ৯ রান করে আউট হন তরুণ বাঁহাতি এই ওপেনার।
শুরুতে উইকেট হারানোর পরও মেজাজ পাল্টাননি লিটন। চার-ছক্কায় এগোতে থাকেন ক্ল্যাসিকাল এই ব্যাটসম্যান। কিন্তু তানজিদ তামিমের মতো তার পথচলাও দীর্ঘ হয়নি। দলীয় ৪১ রানে দিলশান মাদুশঙ্কার শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ২২ বলে ২টি করে চার ও ছক্কায় ২৩ রান করেন লিটন। ৪১ রানে দুই উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন শান্ত ও সাকিব।
শুরুতে রান তুলতে ভুগতে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানিয়ে নেন এই দুই ব্যাটসম্যান, সাবলীল ব্যাটিং করতে থাকেন তারা। জুটি গড়ার পথে দুজনই তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরির পথেই হাঁটছিলেন তারা। কিন্তু অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের বাধায় সেটা হয়নি। দুই রানের মধ্যে এ দুজনকে নিজের শিকারে পরিণত করেন শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার।
তৃতীয় উইকেটে ১৬৯ রান যোগ করেন শান্ত-সাকিব। যা বিশ্বকাপে তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি এবং যেকোনো উইকেটে দ্বিতীয় সেরা। ম্যাথুসের স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ক্যাচ তোলা সাকিব ৬৫ বলে ১২টি চার ও ২টি ছক্কায় ৮২ রানের দারুণ ইনিংস খেলেন। ওয়ানডেতে এটা সাকিবের ৫৬তম হাফ সেঞ্চুরি এবং বিশ্বকাপের ১১তম। নিজের ছায়া হয়ে থাকা বাংলাদেশ অধিনায়ক এবারের বিশ্বকাপে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করলেন।
এক রান পরই আউট হওয়া শান্ত ১০১ বলে ১২টি চারে ৯০ রান করেন। সাকিবের মতো বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন তিনিও। প্রথম ম্যাচে ৫৯ রান করার পর দুই অঙ্কের রানই করতে পারছিলেন না তিনি, দুইবার আউট হন রানের খাতা খোলার আগেই। অবশেষে দুই অঙ্কের ঘরে গেলেন তিনি, তুলে নিলেন ওয়ানডে সপ্তম ও বিশ্বকাপের দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি।
দ্রুত দুই উইকেট হারালেও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে ভালোভাবেই এগোতে থাকে বাংলাদেশ। ২৬ বলে ৩৮ রানের জুটি গড়ার পর মাদুশঙ্কার বলে বোল্ড হন ১৩ বলে ১০ রান করা মুশফিক। ২৩ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২২ রান করা মাহমুদউল্লাহও কিছুক্ষণ পর আউট হলে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। যদিও দাপুটে ব্যাটিং করা তাওহিদ হৃদয় দলকে চাপ বুঝতে দেননি। মিরাজ আউট হওয়ার পর তানজিম সাকিবকে নিয়ে জয়ের কাজটি সারেন তিনি। ৭ বলে ২টি ছক্কায় ১৫ রান করেন হৃদয়। তানজিম সাকিব ৫ রান করেন। মাদুশঙ্কা ৩টি এবং থিকসানা ও ম্যাথুস ২টি করে উইকেট পান।
এর আগে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম ওভারেই উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। ইনিংসের প্রথম ওভারের শেষ বলে কুশল পেরেরাকে ফিরিয়ে দেন শরিফুল ইসলাম। শুরুতেই উইকেট হারালেও লঙ্কানরা অবশ্য চাপ কাটিয়ে তোলে। পাথুম নিসাঙ্কা ও অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসের ব্যাটে এগোতে থাকে তারা। কিন্তু ৬০ পেরিয়ে হঠাৎ-ই দিক হারায় দলটি। সাকিব আল হাসানের পর লঙ্কানদের ইনিংসে আঘাত হানেন বিশ্বকাপে অভিষেক হওয়া তানজিম হাসান সাকিব।
দুই সাকিবের তোপে ৬ রানের মধ্যে ২ উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় উইকেটে নিসাঙ্কার সঙ্গে ৬১ রানের জুটি গড়ে আউট হন মেন্ডিস। সাকিবের বলে শরিফুলের হাতে ক্যাচ দেন ১৯ রান করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। একট পর থামেন নিসাঙ্কাও। তানজিম সাকিবের করা অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে ইনসাইড এজ হন তিনি, ভেঙে যায় তার স্টাম্প। ফেরার আগে ৩৬ বলে ৮টি চারে ৪১ রান করেন নিসাঙ্কা।
এখান থেকে জুটি গড়েন আসালাঙ্কা ও সাদিরা সামারাবিক্রমা, ৬৩ রান যোগ করেন এ দুজন। ৪২ বলে ৪টি চারে ৪১ রান করা সামারাবিক্রমাকে বিদায় করে এই জুটি ভানে সাকিব। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রথমবারের একটি ঘটনা ঘটে। দুই মিনিটের মধ্যেই প্রথম বল মোকবিলা করার জন্য প্রস্তুত না হওয়ায় 'টাইমড আউট' হয়ে ফিরে যান ম্যাথুস। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এভাবে আউট হওয়া একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি।
আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, নতুন ব্যাটসম্যানকে দুই মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত থাকতে হয় প্রথম বল মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু ম্যাথুস সেটা পারেননি। হেলমেট পরছিলেন তিনি, এমন সময় হেলমেটের বেল্ট ছিড়ে যায়। হেলেমেটের জন্য বাইরে ইশারা করেন তিনি, হেলমেট নিয়ে একজন দৌড়েও আসেন। কিন্তু কালক্ষেপণ হওয়ায় আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ জানান বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব। নিয়ম অনুযায়ী ম্যাথুসকে আউট ঘোষণা করা হয়।
এই ঘটনা ভুলে ধনঞ্জয়া ডি সিলভার সঙ্গে ৭৮ রানের জুটি গড়ে তোলেন আসালাঙ্কা। ধনঞ্জয়া ৩৪ রান করে ফিরলে পরে মাহিশ থিকসানার সঙ্গে ৪৫ ও দুশমন্ত চামিরার সঙ্গে ২০ রানের জুটি গড়েন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ও বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া আসালাঙ্কা।
৪৯ ওভার পর্যন্ত ব্যাটিং করা লঙ্কান লঙ্কান এই ব্যাটসম্যান ১০৫ বলে ৬টি চার ও ৫টি ছক্কায় ১০৮ রানের মহাকার্যকর ইনিংস খেলেন। থিকশানা ৩১ বলে ৩টি চারে ২২ রান করেন। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা তানজিম সাকিব ১০ ওভারে ৮০ রানে ৩টি উইকেট নেন। শরিফুল ও সাকিব ২টি করে উইকেট পান। একটি উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ।