বিধ্বংসী গাইডেড বোমায় আকাশযুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া
'গ্লাইড বোমা' ব্যবহার করে চলমান ইউক্রেনযুদ্ধে আকাশপথে দারুণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া। এ বোমার ব্যবহার রাশিয়াকে যুদ্ধে সফলতা এনে দিচ্ছে বলেও মনে করছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা।
সোভিয়েত যুগের এ বোমাগুলো রাশিয়ার ভাণ্ডারে প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে। এক-একটি বোমা আধটন পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে। রাশিয়ান বাহিনী বর্তমানে এসব বোমার গায়ে ডানা ও গাইডেন্স ব্যবস্থা বসিয়ে এগুলোকে স্মার্ট বোমায় পরিণত করছে। এর ফলে এ বোমাগুলো অনেক দূর থেকেই প্রায় নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে নিক্ষেপ করতে পারছে রুশ বিমানবাহিনী।
পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার বর্তমান ক্যাম্পেইনে ড্রোন, মিসাইল ও আর্টিলারির ধ্বংসাত্বক ক্ষমতার সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে এই গ্লাইড বোমাগুলো। ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার এ নতুন কৌশলের পালটা জবাব তাদের কাছে এখনো অধরা। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান চাচ্ছে কিয়েভ, এগুলো দিয়েই রাশিয়ার বিমানবাহিনীর নতুন এ শক্তিকে খর্ব করার পরিকল্পনা ইউক্রেনের।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেন রাশিয়ার আকাশযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের কথা অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু গত বছর প্রথম ব্যবহার করা এ গ্লাইড বোমা মস্কোর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
ইউক্রেনের কাছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও জঙ্গি বিমান দুটোই থাকলেও রাশিয়ান বিমান বাহিনী এগুলোর পাল্লা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে গ্লাইড বোমাগুলো নিক্ষেপ করতে পারে।
পূর্ব ইউক্রেনে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র দিমিত্রি লিখোভি বলেন, 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বোমাগুলো উচ্চমাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। এগুলো সহজেই বাড়িঘর, স্থাপনাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।'
ইউক্রেনের বাহিনীও স্মার্ট তথা গাইডেডে বোমা ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া জেড্যাম (জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন) রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে কিয়েভ। রুশ স্মার্ট বোমার চেয়ে এগুলো বেশি নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারলেও সরবরাহের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে জেড্যাম।
গত মাসে আভদিভকা শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার গ্লাইড বোমাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব বোমার আঘাতে আভদিভকা এখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত শহরে পরিণত হয়েছে।
পোল্যান্ডভিত্তিক রোচান ডিফেন্স কনসালটেন্সির পরিচালক কনার্ড মুজিকা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী বরাত দিয়ে বলেন, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ইউক্রেনীয় অবস্থানের ওপর রাশিয়ার বোমা হামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব হামলার বেশিরভাগেই ব্যবহার করা হয়েছে গ্লাইড বোমা।
তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে সম্মুখ রণাঙ্গনে রাশিয়ান বিমান হামলা নিয়মিত দৈনিক ১০০ ছাড়িয়েছে। আভদিভকার পতনের চারদিন আগ থেকে এ সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়ে যায়। 'এ বোমায় রাশিয়ার খরচ নেই বললেই চলে। আমার তো মনে হয়, তাদের ভান্ডারে এগুলো অসংখ্য রয়েছে, খুব শীঘ্রই এ ভান্ডার ফুরোবে না,' মুজিকা আরও বলেন।
'রাশিয়ার গ্লাইড বোমাগুলো শহুরে এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য বেশ কার্যকর। এসব বোমা দিয়ে ভবনও ধ্বংস করা যায়, সমস্যা হলো কোন ভবনে বোমাটি পড়বে সেটার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ থাকে না,' বলেন এ বিশেষজ্ঞ।
এ বোমাগুলো ভারী লোহা দিয়ে তৈরি, তাই এগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করা কঠিন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা। কারণ, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো সুনির্দিষ্ট গতিপথ ধরে চলা মিসাইল ও রকেট চিহ্নিত করতে তৈরি করা হয়েছে। তাই এগুলো পক্ষে বিমান থেকে ফেলা বোমা প্রতিহত করা কঠিন।
ইউক্রেনীয় সামরিক কর্মকর্তারা মনে করছেন, এসব বোমাকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। বর্তমানে ইউক্রেনীয় পাইলটেরা এ বিমানগুলো ওড়ানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, আগামী গ্রীষ্মের মাঝেই এগুলো রণাঙ্গনে ব্যবহার করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নতুন করে মডিফিকেশনের পর এফ-১৬ বিমানগুলো আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য এআইএম-১২০ মিসাইল বহন করতে পারবে। এর ফলে রাশিয়ান যুদ্ধবিমানগুলো আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে বলেই মনে করছেন ইউক্রেনের সামরিক কর্তৃপক্ষ।
তবে রুশ বিমানশক্তির এ সুসময়েও ইউক্রেনীয় আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করছে, তাদের সাফল্যও কম নয়। কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই রাশিয়ার ১০টি সু-৩৪এস যু্দ্ধবিমান, দুটি সু-৩৫এস যুদ্ধবিমান এবং একটি এ-৫০ সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণ বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে এটি।
অবশ্য ইউক্রেনের এসব দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক বিশেষজ্ঞ ইউক্রেনীয় এসব সংখ্যা বিশ্বাস করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন।
তবে এ-৫০ বিমান ভুপাতিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। রাশিয়ার বিমানবাহিনীর অন্যতম মূল্যবান বিমান এটি। অবশ্য রাশিয়া এ বিমান ধ্বংসের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়নি।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনীর রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার খবরের মাঝেও 'রাশিয়ান বাহিনী আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে গ্লাইড বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে'।
খারকিভ অঞ্চলেও গ্লাইড বোমা হামলার পরিমাণ বাড়িয়েছে রুশ বাহিনী। এ অঞ্চলের গভর্নর ওলেহ সিনিহুবভ সম্প্রতি ইউক্রেনীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, খারকিভের কুপিয়ানস্ক শহরে কিছুদিন আগে প্রথমবারের মতো ক্লাস্টার মিউনিশনসমৃদ্ধ একটি গাইডেড বোমা হামলা করেছে রাশিয়া।
'১০ মাস আগেও শত্রুরা গাইডেড বোমা কালেভদ্রে ব্যবহার করত। এখন এটাই তাদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে,' বলেন এ গভর্নর।